
মোঃ সিরাজুল মনির চট্টগ্রাম ব্যুরো।
ভোরে বন্দীদের ওয়ার্ড থেকে বের করে আদালতে পাঠনো, সাক্ষাৎ কক্ষে কারাবন্দী স্বজনদের চিৎকার চেঁচামেচি, প্রতিদিন কয়েকহাজার স্বজনের পদচারণা এসব ছিল চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার প্রতিষ্ঠার পর থেকে নিত্যদিনের চিত্র। করোনায় মহামারীতে গত এক বছরে পাল্টে গেছে সেই চিত্র। এখন আর মামলার তারিখ অনুযায়ী বন্দীদের আদালতে পাঠানো, সাক্ষাৎকক্ষে স্বজনদের ভিড় কোন কিছুই নেই। কারাগারের চার দেয়ালে ছয় হাজারের বেশি নারী-পুরুষ বন্দী থাকলেও পুরো এলাকায় যেন সুনসান নীরবতা।
গত এক বছর ধরে কারাবন্দীদের সাথে দেখা নেই স্বজনদের। প্রিজন ভ্যানে গাদাগাদি করে আসা যাওয়া নেই আদালতে। এমনকি ঈদেও স্বজনদের সাথে দেখা হয়নি বন্দীদের। কারাবন্দীদের কাছে তিন বেলা খাবারের চেয়ে স্বজনদের সাথে দেখা করা অনেক বেশি গুরুত্বের। প্রতিটি বন্দী উন্মুখ হয়ে থাকে কখন-কার স্বজনের ডাক আসবে।
গত বছরের মার্চ মাস থেকে করোনার প্রকোপ বেড়ে গেলে বন্ধ করা হয় কারাগারের সাক্ষাৎ কক্ষের দরজা। কয়েকমাস পর বন্ধ হয়ে যায় আদালতে আসামি আসা- যাওয়া।
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার দেওয়ান মোহাম্মদ তরিকুল ইসলাম জানান, স্বজনদের সাথে দেখা করতে সকল বন্দীরা অপেক্ষা করে প্রতিদিন। আদালতে আসা যাবার পথেও কম বেশি দেখা হয় স্বজনদের। গত বছরের মার্চ মাস থেকে করোনার প্রকোপ বেড়ে গেলে সাক্ষাৎ কক্ষের দরজা বন্ধ করা হয়। মাঝখানে একমাস সাক্ষাৎ কক্ষের দরজা খুললেও তা ফের বন্ধ করে দেয়া হয়। বন্ধ করে দেয়া হয় স্বজনদের দেয়া বাইরের খাবার দাবারও। বন্দীদের সাথে স্বজনদের সাক্ষাৎ করতে কারাগারে বসানো হয় ল্যান্ড ফোন।
কারাগার সূত্রে জানা যায়, দুই হাজার ধারণ ক্ষমতার চট্টগ্রাম কারাগারে প্রতিদিন ছয় হাজারের বেশি বন্দী থাকে। বছরের পর বছর এক নিয়মে চলে আসা কারাগারের চিত্র করোনার কারণে পরিবর্তন করতে হয়েছে। স্বজনদের সাথে দেখা করতে প্রথম প্রথম বন্দীরা অস্থির হয়ে উঠলে তাদেরকে নিয়মিত কাউন্সেলিং করা হয়। করোনার ভয়াবহতা সম্পর্কে বন্দীদের বোঝানো হয়।
জেলার দেওয়ান মোহাম্মদ তরিকুল ইসলাম বলেন, স্বজনদের সাথে দেখা আর কথা না হলেও কারাগারে থাকা ল্যান্ড ফোন থেকে একজন বন্দী স্বজনদের সাথে সপ্তাহে ১০ মিনিট কথা বলতে পারেন। অনেক সময় মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে কথা বলতে সময় বেশিও দেয়া হচ্ছে। আদালতে আসামি আসা- যাওয়া বন্ধ থাকায় কারাগারে বসানো হয়েছে ভার্চুয়ালি আদালত। আদালতে নির্বিঘেœ শুনানি করতে ব্যবহার করা হচ্ছে ল্যাপটপ ও মুঠোফোন। প্রতিদিন নিয়মিত ভার্চুয়ালি আদালতের শুনানিতে ৩০ থেকে ৪০ জন আসামি জামিন হচ্ছে।
কথা হয় ইশারায়, দেখা হয়ে দু’চোখে : সাক্ষাৎ কক্ষ বন্ধ থাকলেও কারাবন্দীকে দেখতে তাদের স্বজনরা বেছে নিয়েছেন ভিন্ন পথ। গতকাল বুধবার দুপুরে নগরীর কোতোয়ালি থানার জেল রোডে গিয়ে দেখা ভিন্ন চিত্র। জেল রোডের আমানত শাহ দরগাহ সংলগ্ন এলাকায় সড়কের পাশে থেকে কারাগারের অভ্যন্তরে ভবনের জানালা দেখা যায়। কারাগারের বন্দী ভবনের ওই জানালায় দাঁড়িয়ে দূর থেকে বন্দীরা ইশারায় কথা বলছেন সড়কের পাশে দাঁড়ানো স্বজনের সাথে। ইশারায় না বুঝলে বড় আওয়াজে সারছেন কথা বার্তা।
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, কারাভ্যন্তরের উত্তর পাশে থাকা ভবনের তিন, চারতলার জানালা থেকে সড়কের পাশে কিছু অংশ দেখা যায়। ওই ভবনে থাকা বন্দীদের কিছু স্বজন প্রতিদিন সড়কের পাশে এসে দাঁড়ায়। ওদিকে বন্দীরা জানালায় দাঁড়িয়ে স্বজনের সাথে কেউ চিৎকার করে আবার কেউ ইশারায় কথা বলে। যা অনেকটা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো।
কারাগার সূত্রে জানা যায়, করোনা প্রতিরোধে বন্দীদের নিরাপদ রাখতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে কারাগার কর্তৃপক্ষ। এরমধ্যে কামরুজ্জামান নামে একজন হাজতি করোনায় মারা যাবার পর বন্দীদের মধ্যে করোনাভীতি বেড়েছে। করোনা আক্রান্ত হয়েছে কারাগারের দুজন ডেপুটি জেলার একজন নার্স আরো একজন কর্মকর্তা।
কারাগারের অভ্যন্তরে ১৩৫টি ওয়ার্ড রয়েছে। প্রতিটি ওয়ার্ডের ধারণক্ষমতা ৪০ জন করে। করোনা প্রতিরোধে বন্দীদের নিরাপদে রাখতে হালদা ভবনের ২৪টি ওয়ার্ডকে আমরা কোয়ারেন্টিন ওয়ার্ড হিসাবে তৈরি রেখেছি। প্রতিদিন আসা নতুন বন্দীদের প্রথমে শরীরের তাপমাত্রা মাপা হয়। এরপর তাদের হাত ধোয়া ও স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করা হয়। কারাভ্যন্তরে প্রবেশের প্রথম ১৪দিন নতুন বন্দীদের কোয়ারেন্টিন ওয়ার্ডে রাখা হয়। পরবর্তীতে তাদের সাধারণ ওয়ার্ডে পাঠানো হয়। এছাড়া কারাভ্যন্তরে কর্মরত সকল কর্মকর্তা কর্মচারীকে ভেতরে প্রবেশের আগে শরীরের তাপমাত্রা মাপা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।