মিজানুর রহমান অপু,
পটুয়াখালী জেলা প্রতিনিধি।।
পটুয়াখালীর দশমিনার ব্যস্ততম সড়কগুলোতে ড্রেজারের পাইপ লাইন স্থাপন করে বছরের পর বছর বালুর ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে এক শ্রেণীর ব্যবসায়ীরা। তাতে ঝুঁকি নিয়ে চলাচলসহ ভোগান্তিতে পরছেন বিভিন্ন যানবাহনের চালক, যাত্রী ও পথচারীরা।
এছাড়া সড়কের উপর দিয়ে বালু সরবরাহের পাইপ লাইনগুলো স্থাপনের কারণে মাঝেমধ্যেই ঘটছে ছোট বড় দুর্ঘটনা।
সরেজমিনে দেখা যায়, উপজেলা শহরের এনজিও ব্র্যাক অফিসের উত্তর পাশে দশমিনা বাউফল বরিশাল মহাসড়কের উপর দিয়ে আড়াআড়িভাবে পরপর দুটি পাইপ লাইন টানা হয়েছে। উপজেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সামনে সদর রোডে টানা হয়েছে এরকম একটি পাইপ লাইন। একই রাস্তার উপরে উপজেলা পরিষদ ভবনের কিছুটা পূর্ব পাশ দিয়ে স্থাপন হয়েছে আরেকটি পাইপ লাইন।
জানা যায়, সড়কের উপর দিয়ে আড়াআড়িভাবে স্থাপন করা এসব পাইপ লাইন দিয়ে বিভিন্ন এলাকায় বাড়ি ও পুকুর ভরাটসহ সরকারি বিভিন্ন স্থাপনা ও রাস্তা নির্মাণের কাজে এসব লাইন দিয়ে বালু সরবরাহ করা হয়।
সরেজমিনে দেখা যায়, সড়কের উপর আড়াআড়িভাবে প্রায় এক থেকে দেড় ফুট উচু করে ইটের সুরকি, বালু ইত্যাদি দিয়ে পাইপগুলো ঢেকে ডাইভারশন তৈরী করার কারণে পথচারী ও যানবাহন চলাচলে প্রতিনিয়ত প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। সড়কগুলো দিয়ে প্রতিদিন বাস, ট্রাক, ইজিবাইক, রিক্সা, পিকাপ ভ্যান, মটর সাইকেল, জরুরী ওষুধ ও পণ্যবাহী গাড়িসহ বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি যানবাহন চলাচল করে।
এভাবে বছরের পর বছর রাস্তার উপরে যত্রতত্র পাইপ লাইনগুলো থাকলে ঘটে যেতে পারে মারাত্মক দুর্ঘটনা, এমন আশংকা করছেন স্থানীয়রা।
উপজেলার সদর ইউনিয়নের উত্তর কাটাখালী গ্রামের বারেক গাজীর ছেলে জাকির গাজী (৩৮) জানান, ৩ বছর আগে রাতে আলীপুরা থেকে সস্ত্রীক মাহিন্দ্র গাড়িযোগে বাড়ী ফেরার পথে শহরের সদর রোডে এমন পাইপ লাইনের উপরে গাড়ি উল্টে তিনি গুরুতর আহত হয়ে তার ডান কান বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বুক ও বাম হাতসহ উভয় পায়ের চামরা উঠে যায়। বাম পা খন্ড বিখন্ড হয়ে যায়। বর্তমানে তার বাম পায়ের ভিতরে রড স্থাপন করা। মানুষের নিকট থেকে আর্থিক সাহায্য ও জমিজমা বিক্রয় করে প্রায় ৭ লক্ষ টাকা খরচ করে দীর্ঘদিন চিকিৎসা শেষে কিছুটা সুস্থ্য হলেও তিনি কোন ভারি কাজকর্ম করতে পারেন না। তিনি নিঃস্ব হয়ে গেছেন। একই ঘটনায় সাথে থাকা স্ত্রী ফাতেমা বেগমও মারাত্মক আহত হন বলে তিনি জানান।
প্রধান প্রধান সড়কগুলোতে যত্রতত্র যেন কোন পাইপ লাইন স্থাপনের মাধ্যমে এমন বিপদজনক ডাইভারশন তৈরী করা না হয় এমনটাই জানান জাকিরের স্ত্রী ফাতেমা।
উপজেলার বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়নের চরহোসনাবাদ গ্রামের বাসিন্দা ইউনুস সিকদারের ছেলে ও দশমিনা বাজারের ব্যবসায়ী মোঃ নজরুল ইসলাম (৪২) জানান, ২০১৮ সালে বাইক চালিয়ে যাওয়ার সময় শহরের ডাকবাংলোর সামনে সদর রোডে বালু সরবরাহের উঁচু পাইপ লাইনের উপর মারাত্মক দুর্ঘটনায় পতিত হন তিনি। তাতে তার ডান হাত ফ্রাকচার হয়, মুখ মন্ডলের চামড়া উঠে যায় এবং ডান পায়ে গুরুতর জখম হয়ে চার মাস কোন কাজকর্ম করতে পারে নাই। বর্তমানে তার সকল কাজকর্মের পাশাপাশি নামাজ পড়তেও কষ্ট হয়।
দশমিনা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সরকারি এ্যাম্বুুলেন্স চালক মোঃ শাহজাহান হাওলাদার মুঠোফোনে জানান, সড়কে যত্রতত্র এমন পাইপ লাইন থাকার কারণে জরুরী ও মুমূর্ষু রোগী নিয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য বরিশাল ও পটুয়াখালী যাওয়ার পথে বারবার ব্রেক করার কারণে সময় নষ্ট হয়। অজানা স্থাপন করা নতুন পাইপ লাইনগুলোতে হঠাৎ ব্রেক করলে বৃদ্ধ ও গর্ভবতী মহিলা রোগীদের ঝুঁকির আশংকা থাকে।
দশমিনা ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স ষ্টেশনের সদস্য ও গাড়ি চালক মোঃ ওমর ফারুক জানান, আমরা কোন দুর্ঘটনা বা অগ্নিকান্ডের খবর পেয়ে হুইসল বাজিয়ে যখন দ্রুতগতিতে দুর্ঘটনাস্থলে যাই তখন স্থানে স্থানে এসব পাইপ লাইনগুলোর কারণে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। কেউ নতুন পাইপ লাইন বসালে আমাদের জানা থাকে না। আগে পরে কোন প্রতীকি চিহ্ন বা সতর্কবাণী সম্বলিত কোন সাইনবোর্ড বা নির্দেশনা না থাকার কারণে হঠাৎ ব্রেক করতে গিয়ে দুর্ঘটনার আশংকা থাকে। তাছাড়া গাড়ি ব্রেক করে নতুন করে টান উঠাতে গড়ে এক দেড় মিনিট সময় নষ্ট হয়, তাতে দুর্ঘটনাস্থলে ক্ষতির আশংকা বেশি থাকে।
একই ষ্টেশনের ভারপ্রাপ্ত ষ্টেশন অফিসার লিডার আবদুর রশিদ জানান, এগুলোর কারণে সামান্যতম হলেও আমাদের সময় নষ্ট হয়। যত দ্রুত দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পারবো ক্ষতির পরিমাণ তত কম হবে।
উপজেলা সদরের হাজীর হাট এলাকার বাসিন্দা বালু ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন খোকন জানান, আমরা সম্পূর্ণ বৈধভাবে ইজারাদারের নিকট থেকে বালু ক্রয় করে বিক্রয় করি। মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর অন্যতম বাসস্থান। আমরা বেসরকারি বিভিন্ন বাসা বাড়ি নির্মাণসহ সরকারি স্থাপত্য ও রাস্তাঘাট নির্মাণে এ পদ্ধতিতে সাশ্রয়ী মূল্যে বালু সরবরাহ করে থাকি। এটা আমাদের শুধু ব্যবসাই না, এক প্রকার সেবাও। তাছাড়া ইজারাদার সরকারকে রাজস্ব দিয়ে বালুমহালের ইজারা নেয়। আমরা তাদের থেকে টাকা দিয়ে বালু ক্রয় করা মানে সরকারকে রাজস্ব দেওয়া। দুর্ঘটনার ব্যাপারে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, আমার কোন পাইপ লাইনে এখন পর্যন্ত কোন দুর্ঘটনা ঘটে নাই এবং এ ব্যাপারে আমি যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করি।
এ ব্যাপারে অন্যান্য ব্যবসায়ীদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আল-আমিন জানান, জনস্বার্থ ও নিরাপত্তা বিবেচনায় এখন থেকে সকল ব্যবসায়ীকে অনুমতি নিয়ে ডাইভারশন প্রস্তুত করতে হবে। ডাইভারশনগুলোর উভয় পাশে স্পষ্ট দৃশ্যমান সাইনবোর্ড, নির্দেশনা, প্রতীকি চিহ্নের ব্যবহার ইত্যাদিসহ যথাযথ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে ডাইভারশন প্রস্তুতের ব্যাপারে নির্দেশ দিব। প্রয়োজনে বিকল্প নিরাপদ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।