
মাহবুবুর রহমান (শান্ত),
বাংলাদেশ জমইয়তে হিযবুল্লাহর আমির ও ছারছীনা দরবার শরীফের পীর হযরত মাওলানা শাহ্ আবু নছর নেছারুদ্দীন আহমাদ হুসাইন বলেছেন, “বাংলাদেশকে ঘিরে গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। তবে যত চক্রান্তই হোক, কোনো ষড়যন্ত্রই সফল হবে না। এই দেশের মাটিতে অসংখ্য অলি-আউলিয়া ঘুমিয়ে আছেন। তাদের দোয়া ও তাহাজ্জুদের বরকতে বাংলাদেশের জন্য উত্তম কিছু অপেক্ষা করছে।”
তিনি এ কথা বলেন গতকাল রাজধানীর বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ ছাত্র হিযবুল্লাহর কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে প্রধান অতিথির বক্তব্যে। সারাদেশের বিভিন্ন মাদ্রাসা, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা থেকে আগত প্রতিনিধি, পর্যবেক্ষক ও অতিথিদের অংশগ্রহণে উৎসবমুখর পরিবেশে এই কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়।
অনুষ্ঠানের প্রথম অধিবেশন পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত, হামদ ও না’তে রাসূল (সা.) পরিবেশনের মাধ্যমে শুরু হয়। বাংলাদেশ ছাত্র হিযবুল্লাহর সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘জুলফিকার হামদ-না’ত ও গজল পরিবেশক দল’ মনোমুগ্ধকর গজল পরিবেশন করে। উদ্বোধনী অধিবেশনে সভাপতির বক্তব্যে বিদায়ী সভাপতি সংগঠনের অতীত অগ্রযাত্রা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তুলে ধরেন।
দ্বিতীয় অধিবেশনে সংগঠনের সাবেক ও বর্তমান কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দসহ অতিথিরা আলোচনায় অংশ নেন। পরে মুহাম্মদ আবু ওয়াক্কাসকে সভাপতি ও মুহাম্মদ মুহিব্বুল্লাহ ছালেহীকে সাধারণ সম্পাদক করে ১৫১ সদস্য বিশিষ্ট নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়। নির্বাচিত নেতারা পরবর্তী তিন বছরের জন্য সাংগঠনিক দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বিদায়ী মহাসচিব মুহা. বাহাউদ্দীন মোস্তাফীর সঞ্চালনায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন বিদায়ী সভাপতি মুফতি শামসুল আলম মোহেব্বী।
পীর সাহেব ছারছীনা বলেন, “আমরা রাজনীতি করি না, কিন্তু এর মানে এই নয় যে আমরা ইসলামের বিরোধী। যারা রাজনীতি করেন আমরা তাদের বিরুদ্ধে নই; ইসলামের স্বার্থে আমরা তাদের পরামর্শ ও সমর্থন দিতে প্রস্তুত। ছারছীনা কখনো রাজনীতি করে না, কিন্তু দেশের রাজনীতিকরা ছারছীনা থেকে দিকনির্দেশনা নেন এবং সে অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তও হয়।”
তিনি আরও বলেন, “ইসলাম শান্তির ধর্ম, অথচ কেউ কেউ আজ অশান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করছে। কোনো মুসলমান কখনো মুসলমানকে গালি দিতে পারে না। এই দেশ অলিদের দাওয়াতে ইসলাম গ্রহণ করেছে, কোনো রাজনীতিকের মাধ্যমে নয়।”
পীর সাহেব অতীত ইতিহাস স্মরণ করে বলেন, “পাকিস্তান আমলে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ছারছীনা দরবারে আসেন। তখন তাঁর সঙ্গে থাকা সৈনিকদের পোশাকে ছিল হাফপ্যান্ট, যার কারণে অনেক মুসলিম সৈনিক জুমার নামাজে অংশ নিতে পারেননি। বিষয়টি লক্ষ্য করে ছারছীনার পীর সাহেব আইয়ুব খানকে পরামর্শ দেন যেন সৈনিকদের ফুলপ্যান্ট পরিধানের নির্দেশ দেওয়া হয়। পরবর্তীতে আইয়ুব খান সে অনুযায়ী আদেশ জারি করেন।”
তিনি আরও উল্লেখ করেন, “প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ছারছীনার পীর সাহেবের পরামর্শেই সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ সংযোজন করেন। প্রেসিডেন্ট এরশাদের সময় তাঁর পরামর্শে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ঘোষণা এবং সাপ্তাহিক ছুটি রবিবার থেকে পরিবর্তন করে শুক্রবার করা হয়। এমনকি রেডক্রসের নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশে ‘রেডক্রিসেন্ট’ করা হয়।”
তিনি বলেন, “আমরা রাজনীতি না করলেও, ইসলামের স্বার্থে রাজনৈতিক নেতাদের যথাযথ পরামর্শ দিয়ে জাতিকে সঠিক পথে পরিচালিত করা আমাদের দায়িত্ব। দেশে যারা ইসলামি রাজনীতি করেন, তাদের প্রতি আমাদের কোনো আপত্তি নেই, তবে অলিদের এই দেশে অপরাজনীতির কোনো স্থান নেই।”
ছারছীনার ঐতিহাসিক ভূমিকা তুলে ধরে তিনি বলেন, “প্রথম পীর শাহ আবু নছর আহমদ (রহ.)-এর দাদা ইসলামের খেদমতে অসাধারণ অবদান রেখেছেন। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্দুর রহমান বিশ্বাসসহ বহু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছারছীনা দরবারে দোয়া নিতে গিয়েছেন। এই দরবার সবার জন্য উন্মুক্ত।”
পীর সাহেব বলেন, “ছারছীনা বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। সারাদেশে সাড়ে চার হাজার আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সরকার ছারছীনার মূল পীরের দাদাকে শিক্ষা অনুরাগী হিসেবে স্বীকৃতি ও স্বর্ণপদক প্রদান করেছে। আমার পিতা আড়াই হাজার মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন, যা আজও চালু আছে এবং ভবিষ্যতেও চলবে। সেই প্রতিষ্ঠান থেকেই ইসলামী আদর্শে গঠিত ছাত্র হিযবুল্লাহর নেতৃত্ব তৈরি হবে, ইন শা আল্লাহ।”
তিনি আরও বলেন, “কেউ কেউ মাজার সাজিয়ে ইসলামের নামে অপসংস্কৃতি ছড়ায়, যা ছারছীনা সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করে। ছারছীনা কেবল শরীয়াহ ভিত্তিক ও আহলে সুন্নাহর পথ অনুসরণ করে।”
শেষে তিনি বলেন, “বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় সংকট নৈতিকতা ও আদর্শের। ছাত্র সমাজ যদি আল্লাহভীরু হয়, তবে সমাজে সত্য, ন্যায় ও আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হবে। ছাত্র হিযবুল্লাহর কর্মীদের উচিত আওলিয়া কেরামের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ইসলামী চেতনা ও নৈতিক জাগরণ সৃষ্টি করা। তবেই সমাজ থেকে বাতিল মতবাদের প্রভাব দূর হবে এবং বাংলাদেশ হবে ইসলামী আদর্শে পরিচালিত একটি শান্তিময় রাষ্ট্র।”
অনুষ্ঠানে অন্যান্য বক্তাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সভাপতি ও দৈনিক ইনকিলাবের সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীন, জমইয়তে হিযবুল্লাহর সিনিয়র নায়েবে আমীর মুফতি শাহ আবু বকর মোহাম্মদ ছালেহ নেছারুল্লাহ, নায়েবে আমীর মির্জা মো. নুরুর রহমান বেগ, দারুন্নাজাত সিদ্দীকিয়া কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আ. খ. ম. আবু বকর সিদ্দিক, ড. সৈয়দ মো. শরাফত আলী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ রুহুল আমীন এবং ইউনাইটেড ঢাকা শাখার সভাপতি জজ মুহা. ইসমাইল প্রমুখ।
























