হোসাইন রুবেল ভোলা ।।
‘অহন আল্লাহর দিকে চাইয়া আমার পোলাডারে একটু আইনা দিয়েনও। আমার কইজাডার মইধে থুমু। হেদিন সাড়ে ১২টার কালে পোলাডারে লইয়া গেছে। আমরা পোলা নির্দোষ অন্য পোলাহানের নাম দিয়া আমার পোলাডারে দইরা নিছে। আলগা মাইনষের লইগা আমার পুতেরে কিল্লাই আটকাইয়া থয়। পোলাডায় কেমন করে, এই শোকে আমি বাচি না।’
ভোলা সদর উপজেলার পূর্ব ইলিশা ইউনিয়নের বাগার হাওলা গ্রামের নিরপরাধ ছেলের শোকে কাতর হয়ে কাঁদতে কাঁদতে এভাবে কথাগুলো বলছিলেন ৮০ বছরের বৃদ্ধা কদবানু বেগম।
কান্নার কারণ জানতে কদবানু বেগম ও তার পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বললে জানা যায়, নিজের নাম ও বাবার নাম কিছুটা মিল থাকায় হত্যা মামলার প্রধান আসামি হিসেবে কদবানু বেগমের ছেলে মো. শাজাহান মুন্সীকে আটক করে জেলহাজতে পাঠায় ভোলা সদর থানা পুলিশ ও আদালত।
মো. শাজাহান মুন্সী পূর্ব ইলিশা ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের মুন্সী বাড়ির আজিজুল হকের ছেলে। তিনি পূর্ব ইলিশা নেছারিয়া মাদরাসার অফিস সহকারী পদে কর্মরত আছেন।
মামলা সূত্রে জানা যায়, ২৫ বছর আগে ১৯৯৭ সালের ২০ মার্চ ভোলা সদর উপজেলার পূর্ব ইলিশা ইউনিয়ন বাঘার হাওলা গ্রাম ৫ নং ওয়ার্ড চৌকিদার বাড়ির স্থায়ী বাসিন্দা আবদুল আজিজের ছেলে মো. হানিফ ওরফে শাহাজাহানের ঢাকার সবুজবাগ এলাকায় আপন বড় ভাই রফিকুল ইসলামের স্ত্রীর সঙ্গে পরকীয়া স¤পর্ক ছিল। এর জের ধরে বড় ভাই রফিকুল ইসলামকে হত্যা করেন মো. হানিফ ওরফে শাহাজাহান। এ ঘটনায় রফিকুল ইসলামের স্ত্রী জোসনা ওরফে মানছুরা বাদী হয়ে সবুজবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা করেন, যার মামলা নং-৭৮ ধারা ৩২০/৩৪।
এ ঘটনায় পুলিশ তখন মামলার প্রধান আসামি মো. হানিফ ওরফে শাহাজাহানকে গ্রেফতার করে। আদালতের মাধ্যমে দীর্ঘ চার বছর কারাভোগ করেন তিনি। এরপর জামিনে এসে দুবার আদালতে হাজির হয়ে তারপর থেকে পলাতক রয়েছেন। এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নিহতের স্ত্রী জোসনার সঙ্গে সখ্য থাকায় জোসনা ও মো. হানিফ ওরফে শাহাজাহান বিরুদ্ধে মামলার প্রতিবেদন দাখিল করেন। তা গ্রেফতার ওয়ারেন্ট জারি হয়।
মামলার প্রধান আসামি ভোলা জেলার বাসিন্দা হওয়ায় মামলাটি ভোলা সদর মডেলে আসে। তখন ভোলা মডেল থানার এসআই মো. কবির সঠিক নাম-ঠিকানা যাচাই-বাছাই না করেই গত ২৩ অক্টোবর নিরপরাধ মো. শাহাজাহান মুন্সীকে তার কর্মস্থল পূর্ব ইলিশা নেছারিয়া মাদরাসা থেকে সাদাপোশাকে তুলে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ করেন মো. শাহাজাহান মুন্সীর পরিবার। তারা বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গাফিলতির কারণে দীর্ঘ ২৭ দিন ধরে জেলে রয়েছেন নিরপরাধ মো. শাহাজাহান মুন্সী।
জাতীয় পরিচয়পত্রে দেখা যায়, হত্যা মামলার প্রধান আসামির নাম দেওয়া আছে মো. হানিফ ওরফে শাজাহান, পিতা : আবদুল আজিজ, মাতা : বিবি জলেখা, গ্রাম-পূর্ব চর ইলিশা বাঘার হাওলা ৫নং ওয়ার্ড চৌকিদার বাড়ি। অন্যদিকে নিরপরাধ মাদরাসার অফিস সহকারীর পরিচয় দেওয়া আছে মো. শাজান, পিতা : আজিজুল হক, মাতা : কদবানু বেগম, জন্মতারিখ ৫ আগস্ট ১৯৭৫, গ্রাম: পূর্ব চরইলিশা বাঘার হাওলা ২নং ওয়ার্ড মুন্সী বাড়ি।
এ বিষয়ে কথা হয় মো. শাহাজাহান মুন্সীর মেয়ে শাহানাজ বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমার বাবা একজন নিরীহ মানুষ। তিনি মাদরাসায় চাকরি করেন। খুনের ঘটনার সঙ্গে তার কোনো স¤পর্ক নেই। একটা নামের মিল থাকার কারণে অন্য আসামির পরিবর্তে আমার বাবাকে ধরা হয়েছে। ওই দিন হঠাৎ থানার এসআই কবিরসহ র্যাব এসে মাদরাসা থেকে বাবাকে ধরে নিয়ে কোটে চালান দিয়ে দেয়। বিনা কারণে এক মাসের মতো আমার বাবা জেল খাটতেছেন।
তিনি আরও বলেন, যখন বাবাকে ধরে নিয়ে যায়, তখন থেকে থানা পর্যন্ত একাধিকবার এসআই কবিরকে জিজ্ঞেস করা হইছে, কী অপরাধ আমার বাবার? কেন তাকে আটক করা হইছে? এসআই কোনো উওর না দিয়ে বলেন, ‘কোর্টে চালান করা হইছে, সেখানে যোগাযোগ করেন’।
মো. শাহাজাহান মুন্সীর স্ত্রী বলেন, আমার নির্দোষ স্বামীরে পুলিশ ও র্যাব ধইরা নিয়া হাজত খাটাইতেছে। আমার স্বামী খুন তো দূরের কথা, কোনো সময় একটা মুরগি মাইরাও দেখে নাই। আমি আমার স্বামীর মুক্তি চাই এবং এর পেছনে যারা জড়িত আছে, তাদের বিচার চাই।
শাহাজাহান মুন্সীর ছেলে কলেজশিক্ষার্থী মো. নকিব বলেন, বাবার মাদরাসার বেতনের টাকায় আমাদের সাত-আটজনের সংসার চলত। পুলিশের এই ভুলের জন্য আমরা পথে বইসা গেছি। পুলিশের এই ভুলের জন্য অভাবের সংসারে আরও অভাব লেগেছে। এখন আমার নিরপরাধ বাবার মুক্তি হবে কীভাবে?
অন্যদিকে এই মামলার মূল আসামি মো. হানিফ ওরফে শাহাজাহানের বাড়িতে গেলে তার স্ত্রী জয়নব বিবির সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ২৫ বছর আগে আমার বাসুর রফিক হত্যার দায়ে আমার স্বামী সাজা খাটছে (কারাভোগ) তার দুই বছর হাজিরা দিছে। পরে আর দেয় নাই। তারপর বাড়িতে কাজ করছে, থাকছে। আইজ এক-দেড় মাস সে কই গেছে, আমরা কিছু জানি না। এহন এই মামলায় ওই বাড়ির একজনরে পুলিশ লইয়া গেছে। এহন আবার ওয়াডার হইছে হত্যা মামলার আসামি। শাহাজান দুই মেয়ে ও এক সন্তানের জনক।
এ ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও দায়িত্বশীল হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন ভোলার সচেতন মহল।
ভোলার দৈনিক আজকের ভোলা স¤পাদক ও প্রবীণ সাংবাদিক শওকাত হোসেন বলেন, আমরা সাধারণভাবে দেখে এসেছি এক জেলার আসামি অন্য জেলার বাসিন্দা হলে ওই এলাকার গোপনে জনপ্রতিনিধি, গ্রামপুলিশসহ এলাকায় একাধিক যাচাই-বাছাইয়ের পরে আসামি চিহ্নিত করে এবং তার পরবর্তীতে আটক করে। কিন্তু ইলিশার এ ঘটনায় এ রকম কিছু হয়েছে বলে মনে হয় না। এসব বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আরও দায়িত্বশীল হওয়ার প্রয়োজন। তা না হলে সমাজের সম্মানিত ব্যক্তিরা তাদের দায়িত্বহীনতায় পদে পদে অসম্মানীত হতে হবে।
ভোলা সদর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) কবির হোসেন জানান, মূলত ঢাকা থেকে যেই ওয়ারেন্টের কাগজ এসেছে, তাতে আসামির নাম উল্লেখ আছে শাজাহান। ওই এলাকায় একই নামে দুজন আছে, তাদের বাবার, দাদার ও ভাইয়ের নাম হুবহু এক। ওই আসামিকে র্যাব আটক করেছে, আমি সঙ্গে ছিলাম। আর ওয়ারেন্টের নামের সাথে ব্যক্তির নামের মিল থাকায় তাকে আটক করে আদালতে চালান করে দেওয়া হয়েছে।
ভুক্তভোগীর পরিবারের অভিযোগ বিষয়ে তিনি বলেন, তারা যে অভিযোগ করছে, আমি তাদের মামলা সম্পর্কে কিছু বলি নাই, এটা সম্পন্ন ভুল। আমি তাদের ওয়ারেন্টের কপিটা ছবি তুলে দিয়েছি। মূলত নামে মিল থাকায় এমনটা হয়েছে। তবে লোকটি নির্দোষ, তার ভাগ্য খারাপ।
তিনি আরও জানান, পরবর্তীতে বিষয়টি আমরা জানার পর এর থেকে মুক্তির জন্য সব রকমের পরামর্শ দিয়েছি তাদের।
ভোলা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এনায়েত হোসেন জানান, নাম-ঠিকানা সব এক হওয়ায় এমনটা ঘটেছে। এই নিরপরাধ ব্যক্তির মুক্তির জন্য আমরা ইলিশা ফাঁড়ির এসআই ফরিদ উদ্দিনকে তদন্ত করে রিপোর্ট দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছি। আশা করি রিপোর্ট আদালতে দাখিল করলে নিরপরাধ মো. শাজাহানের মুক্তি মিলবে।