মো: আব্দুর রহিম
শরীয়তপুর প্রতিনিধি।।
অভাবের সংসারে তিনবেলা খাওয়া ও ছোটভাই-বোনদের পড়াশোনায় সহযোগীতা করতে নিজে ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে আর এগোতে পারেনি জুনায়েদ। বাবা অন্যের জমিতে কৃষি কাজ ও দিনমজুরের কাজ করে সংসারের হাল ঠিক রাখতে পারেন না- তাই কাজের সন্ধানে বের হয়ে ঢাকায় একটি কম্পিউটারের দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ শুরু করে জুনায়েদ।
বলছিলাম শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার রাজনগর ইউনিয়নের বিলদেওনিয়া এলাকার বাসিন্দা শাহআলম ফরাজির বড় ছেলে মো: জুনায়েদ হোসেনের -১৭- কথা। চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনে সহিংসতার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন জুনায়েদ হোসেন।
জানা যায়- গত ১৯ জুলাই বিকেলে জুনায়েদ তার কর্মস্থল মিরপুর ১০ এ অবস্থিত আইটি গ্যালারি নামের কম্পিউটারের দোকান বন্ধ করে মিরপুর ২ এলাকার বাসায় ফিরছিল। তখন সেখানকার সড়কে সংঘর্ষ শুরু হলে জুনায়েদ আবারো তার কর্মস্থলে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করলে বুক বরাবর বাম পাশের পিছন দিক দিয়ে একটি গুলি বিদ্ধ হয়ে সামনে দিয়ে বেড়িয়ে যায়। পরে পথচারীরা তাকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখান থেকে চিকিৎসকরা তাকে জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউটে প্রেরণ করলে সেখানে পৌঁছালে কর্তব্যরত চিকিৎসক সন্ধা সোয়া ৭ টার দিকে তাকে মৃত ঘোষনা করেন।
নিহত জুনায়েদের কর্মস্থল আইটি গ্যালারির মালিক সবুজ আলম মুঠোফোনে বলেন, “জুনায়েদ অত্যন্ত শান্ত ও ভদ্র একটি ছেলে ছিল। সবসময় মনোযোগ দিয়ে কাজ করতো। ঐদিন -১৯ জুলাই- যখন মিরপুর ১০ এলাকায় সংঘর্ষ শুরু হয় তখন আমি জুনায়েদসহ আমার দোকানের ৪ কর্মচারীকে দোকান বন্ধ করে বাড়ীতে চলে আসতে বলি। তার কিছুক্ষণ পরে ফোনে জানতে পারি জুনায়েদ বাড়ীতে আসার সময় গুলিতে আহত হয়েছে। তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। তখন হাসপাতালে গিয়ে জানতে পারি জুনায়েদ মারা গেছে। তিনি আরো জানান- ঐদিন আমাদের ঐ গলিতে জুনায়েদসহ আরো ৩-৪ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। এরমধ্যে ওখানকার এক বাড়ীর দারওয়ান ও চা খেতে আসা এক লোক ছিল।
পরিবার ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়- জুনায়েদের পরিবারে তার আরো ২ ভাই ও এক বোন রয়েছে। তারা সবাই বিভিন্ন স্কুল কলেজে পড়াশোনা করছে। তাদের মধ্যে জুনায়েদই সবার বড়। এছাড়াও তার পরিবারে রয়েছে বাবা- মা ও তার দাদী। জুনায়েদের পরিবারে উপার্জনক্ষম হিসেবে বাবা শাহআলম ফরাজী ও জুনায়েদ নিজে। তাদের দুজনের আয় দিয়েই সংসার চলতো। জুনায়েদকে হারিয়ে পরিবারটি খুবই ভেঙ্গে পড়েছে।
শনিবার -৩০ জুলাই- জুনায়েদের বাড়ীতে গিয়ে দেখা যায়- তাকে বাড়ীর সামনে সড়কের পাশেই দাফন করা হয়েছে। তার বাবা- মা- দাদী সহ ছোট ভাইবোনেরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছেন। জুনায়েদের মা ডলি বেগম বার বার জুনায়েদের কবরের কাছে গিয়ে কান্না করতে করতে মূর্ছা যাচ্ছেন। আর বলছেন- ওরা কেন আমার বুকের ধন কেড়ে নিলো। আমার ছেলেতো কারো কোন ক্ষতি করেনি। আমি এখন কার কাছে এই বিচার চাইবো।
নিহত জুনায়েদের বাবা শাহআলম ফরাজি বলেন- আমাদের বাড়ী ছাড়া নিজেদের আর কোন জমিজমা নেই। আমি অন্যের জমিতে কাজ করি। তাই সংসার চালাতে সহযোগীতা করতে আমার বড় ছেলে জুনায়েদ ঢাকায় একটি কম্পিউটারের দোকানে কাজ করে প্রতিমাসে ৮-১০ হাজার টাকা পাঠাতো। তা দিয়েই বাকী ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা আর ভরণপোষণের ব্যবস্থা করতাম। এখন আমি অথৈ সাগরে ভেসে গেলাম। আমার জুনায়েদ মারা যাওয়ার দুই ঘন্টা আগেও ওর মা ও আমার সাথে ফোন করে কথা বলেছিল। বলেছিল দোকান বন্ধ করে বাড়ীতে চলে যাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত লাশ হয়ে ফিরল আমার ছেলেটি। আমি আমার সন্তান হত্যার বিচার চাই।
স্থানীয় বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম বলেন- জুনায়েদ ছেলেটি খুবই দায়িত্বশীল ও ভদ্র প্রকৃতির ছিল। কখনো কারো সাথে গায়-গেঞ্জামে যেতো না। সে মারা যাওয়ায় পরিবারটি খুবই বিপাকে পড়েছে। কেননা জুনায়েদ যা টাকা আয় করে পাঠাতো তা এবং ওর বাবার দিনমজুরির টাকা দিয়ে পরিবারটি কোনরকমে চলছিল। এখন সরকারের পক্ষ থেকে কোন সহযোগীতা পেলে হয়তো কোনরকমে চলতে পারবে পরিবারটি। নয়তো জুনায়েদের ছোটভাইবোনের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
এ বিষয়ে রাজনগর ইউপি চেয়ারম্যান আবু আলেম মাদবর বলেন- আমার বাড়ির পাশেই জুনায়েদদের বাড়ি। সম্পর্কে সে আমার ভাতিজা হয়। পরিবারের হাল ধরতে বড় ছেলে হিসেবে জুনায়েদ ঢাকার একটি কম্পিউটার দোকানে কাজে গিয়েছিলো। সেখানে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। আমি ব্যক্তিগত ভাবে তার পরিবারকে সার্বিক সাহায্য সহযোগিতা করবো।