মো: আব্দুর রহিম
শরীয়তপুর প্রতিনিধি।।
নিদারুণ ভাতের কষ্ট আর দারিদ্র্যকে মাড়িয়ে সবেমাত্র এক যুগ হলো সুখের মুখ দেখেছিলেন ব্যাংক কর্মকর্তা দুলাল মাহমুদ -৩৮- । ঘর করার জন্য গ্রামে কিনেছিলেন এক টুকরো জমিও। বাবা-মা- স্ত্রী আর দুই ফুটফুটে সন্তানকে নিয়ে পেতেছিলেন সুখের সংসার। তবে সেসব আজ শুধুই স্মৃতি। বুলেটের আঘাত কেড়ে নিয়েছে গোটা পরিবারটির হাসি। ছেলে আর বাড়ি ফিরবে না- ডাকবে না মা বলে- এই কথা মনে করতেই ডুকরে কেঁদে উঠেন মা জলেখা বিবি। বিচার চান ছেলে হত্যার।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়- দুলাল মাহমুদের বাড়ি শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার চরখাগুটিয়া চৌকিদার কান্দি এলাকায়। সিদ্দিক খালাসী ও জলেখা বিবির ৭ সন্তানের মধ্যে তিনি চতুর্থ। ছোটবেলা থেকেই দারুণ অর্থ কষ্টে দিন কেটেছে তাদের।
একদিকে বাবা কুষ্ঠ রোগী আর অন্যদিকে গরিব হওয়ায় ছোটবেলা থেকে কাজ শুরু করেন দুলাল। পড়াশোনা চালিয়ে যেতে কখনো চালিয়েছেন ভ্যান- আবার কখনো দিয়েছেন কৃষান। ২০০১ সালে পূর্ব নাওডোবা পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাস করেন তিনি। পরে ভাতের অভাবে গ্রাম ছেড়ে পাড়ি জমান মুন্সিগঞ্জ জেলায়। সেখানে একটি বাড়িতে লজিং থেকে শেষ করে উচ্চ মাধ্যমিক ও কলেজ জীবন। এরপর ঢাকায় শুরু করেন চাকরির সন্ধান। ১৪ বছর আগে স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংকে চাকরি হয় তার। আসতে আসতে সুদিন ফিরে আসে। ৮ বছর আগে বিয়ে করেন। বর্তমানে তার সংসারে ৭ বছরের আদিয়াত ও সাড়ে তিন বছরের আরিশা নামের দুটি সন্তান রয়েছেন।
গত ১৮ জুলাই বিকেল থেকেই ঢাকার আজিমপুর এলাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ চলছিল। এদিন অফিস শেষ করে বাসায় ফিরছিলেন দুলাল মাহমুদ। তিনি বাসার সামনে গলির মাথায় আসতেই হঠাৎ করে একঝাঁক রাবার বুলেট এসে বিদ্ধ করে তার হাত আর পেটের অংশে। মুহূর্তের সব শেষ। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন দুলাল। রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে নিয়ে স্থানীয়রা ছুটে যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এর পরেরদিন চিকিৎসাধীন অবস্থায় চির দিনের মতো ঘুমিয়ে পড়েন তিনি। পরে গ্রামের বাড়িতে তার মরদেহ দাফন করা হয়।
সরেজমিনে দুলাল মাহমুদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়- তার কিনে রাখা এক খণ্ড জমির পাশে তাকে কবর দেয়া হয়েছে। মা জলেখা বিবি তবজি জপে ছেলের জন্য দোয়া করছেন। ছেলের শোকে পাথর হয়ে বসে আছেন বাবা সিদ্দিক খালাসীও।
সন্তান দুলাল মাহমুদের এমন করুণ মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না মা জলেখা বিবি। তদন্ত করে দোষীদের বিচারের আওতায় আনার দাবি তার। জলেখা বিবি বলেন- ছোট বেলা থিকা পোলারে দুইডা টাকা দিতে পারি নাই। নিজে বদলা দিয়া- মানুষের দোকানে কাম কইরা পড়ালেহা করছে। এহন সে চাকরি পাইছে। কিন্তু আমার নির্দোষ পোলাডারে মাইরা ফেলল। আমার বুক খালি কইরা- আমার নাতি নাত কুর দুইডারে এতিম বানাইয়া দিল। আমি আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই।
ছোট ভাই জসিম খালাসী বলেন- টাকার অভাবে আমরা ভাইরা আর কেউ পড়াশোনা করতে পারি নাই। দুলাল ভাই নিজে পড়াশোনার জন্য ভ্যান চালাইছে, মানুষের বাড়িতে কাম করছে। তিনিই আমাগো দেইখ্যা রাখতো। আজ তিনি আর নাই। আমাদের একটাই দাবি ভাইয়ের পরিবারটির পাশে যেন সরকার দাঁড়ায়।
কোয়েল খালাসি নামের এক স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, দুলাল ভাই কখনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। এমনকি বেশি মানুষের ভিড় কিংবা আড্ডা পছন্দ করতেন না। আমরা শুনেছি, ওনি অনেক কষ্ট করে এই অবস্থানে এসেছেন। তাদের বাড়ি থেকে বর্ষায় রাস্তায় আসতে পানি পড়ে। তিনি গামছা পড়ে পানি পাড় হয়ে, জামাকাপড় পরিবর্তন করে স্কুলে যেতেন। খুব মেধাবী ছিলেন। তার এমন মৃত্যু আমরা মেনে নিতে পারছি না।
জানতে চাইলে পূর্ব নাওডোবা পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক ইদ্রিস আলী বলেন- আমরা ওকে কখনো দেখিনি রাজনীতি করতে বা কারও সঙ্গে উচ্চ বাক্যে কথা বলতে। ভীষণ গরিব পরিবারের সন্তান ছিল দুলাল। আমাদের স্কুল থেকে পাস করার পর একপর্যায়ে শুধু ভাতের অভাবে- পড়াশোনার জন্য মুন্সিগঞ্জে চলে যায়। সেখানে লজিং মাস্টার থেকে পড়াশোনা শেষ করে এখন একটা ভালো অবস্থানে এসেছিল। হঠাৎ করে এমন ঘটনা আমাদের হৃদয় নাড়িয়ে দিয়েছে। আমরা চাই সরকার পরিবারটির পাশে দাঁড়াক।
বড়কান্দি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ লুৎফর রহমান বলেন- দুলাল জীবনে অনেক কষ্ট করে সফলতা পেয়েছে। তার এমন মুত্যু দু:খজনক। দুলাল ও তার পরিবার কোন রাজনৈতিক দলের সাথেও যুক্ত নয়। আমরা পরিষদের পক্ষ থেকে দুলালের পরিবারের সদস্যদের পাশে সবসময় থাকব।
এ বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন শরীয়তপুরের প্যানেল আইনজীবী রওসন আরা বলেন- জাজিরার দুলাল মাহমুদ ঢাকায় কর্মস্থল থেকে বাসায় ফেরার সময় গুলিতে নিহত হয়েছেন। তার পরিবারে বৃদ্ধ মা-বাবা আর দুটি সন্তান ও স্ত্রী রয়েছে। এই অবস্থায় কর্মক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে পরিবারটি বিপাকে পড়েছেন। আমরা চাই সরকার পরিবারটির পাশে দাঁড়াক।