মোঃ আবু তৈয়ব
হাটহাজারী চট্টগ্রাম- প্রতিনিধি।।
কালের আবর্তে সময়ের প্রবহমানতায় আমার শিক্ষকতা জীবন দুই যুগ ছুঁই ছুঁই। দীর্ঘ সময় যে কিভাবে অতিক্রান্ত হয়ে গেলো বুঝে ওঠতে পারছিনে। আজ ০৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস। প্রতিবছর আসে ০৫ অক্টোবর। দিবসটিকে উপলক্ষ করে যতই নিজের পেশা সম্পর্কিত নানান ভাবনা মাথার ভেতর ঘুরপাক খায়। পেশাগত নানান ভাবনা ইচ্ছে করে শেয়ার করতে প্রিয় পাঠকদের সাথে।। কিন্তু আলস্য বারবার অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। আলস্যকে পিছু ঠেলে কী বোর্ডে হাত রাখলাম।
লিখতে বসে মনের স্ক্রীনে প্রথম যে প্রশ্নটি ভেসে ওঠলো,সেটি – শিক্ষকতা কি? এ পেশায় আমার দু’যুগ পথ পরিক্রমার অভিজ্ঞতা বলে, শিক্ষকতা কেবল জ্ঞান দান নয়। এর চেয়েও বেশি কিছু। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দানের পাশাপাশি উৎসাহ উদ্দীপনা দিয়ে জীবনের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর নিরন্তর শক্তি যোগানোই শিক্ষকতা। আবার কখনো মনে হয়েছে শিক্ষকতা একটি কম্পাস বৈ কিছুই নয়। যে কম্পাস দিকভ্রান্ত জাতিকে দেয় সঠিক পথের নির্দেশনা। কখনো মনে হয়েছে শিক্ষকতা কাজী নজরুলের আজ “সৃষ্টি সুখের উল্লাসে ” কবিতা—
আজ সৃষ্টি – সুখের উল্লাসে –
মোর মুখ হাসে, মোর চোখ হাসে মোর টগবগিয়ে খুন হাসে- আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে।
কেননা,জগতের যত কবি,সাহিত্যিক, লেখক,বুদ্ধিজীবি,বৈজ্ঞানিক,দার্শনিক,
আইনজ্ঞ, চিকিৎসাবিদ সহ সকল পেশাজীবি মানুষের পেছনে রয়েছে যাঁদের অক্লান্ত শ্রম, মেধার বিনিয়োগ,নির্মান শৈলী তাঁরাই শিক্ষক। যাঁদের কাছে এসে সকলেই হৃদয়ের মণিকোঠা হতে বিনা স্বার্থে,বিনা শর্তে পরম শ্রদ্ধা আর গভীর মমতায় সম্মান নিবেদন করেন তাঁরাই শিক্ষক। তাঁদের পেশাটিই শিক্ষকতা।
মনের গহীনটা যেন টলমল জলের মতো। ছোট ছোট ঢেউ সেথা অনিমেষ ছুটোছুটি করে। ওঠে ভাবনার বুদবুদ। উদয় হয় নানান প্রশ্নের। এ মুহূর্তে যে প্রশ্নটি বুদবুদ হয়ে বেরিয়ে এলো সেটি – শিক্ষক কে? বা শিক্ষক কাকে বলে? শিক্ষকের কাজই তো নানান প্রশ্নের উত্তর খোঁজা,আর উত্তর দেয়া। তাই এতক্ষণে আমার মন অস্থির হয়ে পড়েছে এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজতে। দেখি কী উত্তর পাওয়া গেলো মনের খাতার পাতায় পাতায় ?
শিক্ষক একটি মোমবাতি। মোমবাতি যেমন নিজেকে দহন করে তার চারপাশটা আলোকিত করে, ঠিক তেমনি শিক্ষক তার শিক্ষার্থীদের আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে নিজেকে দগ্ধ করে তাদের মনের মাঠে আলোর চাষ করে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে লুকিয়ে থাকা অন্ধকার, কুসংস্কার, অনাচার, দূর করে আলোকিত সমাজ বিনির্মান করে যাঁরা তারাই শিক্ষক। মাঝে মাঝে মনে হয়, শিক্ষক প্রকৃতির অকৃত্রিম ঝর্ণাধারা। ঝর্ণা থেকে যেমন অবিরাম প্রবাহিত হয় স্বচ্ছ, সুপেয় মিষ্টি পানি ঠিক তেমনি অনুপ্রেরণার এক অফুরান স্রোতধারা শিক্ষক। সদা সর্বদা শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করাই যেন তাঁর ব্রত। শিক্ষক নিজেও জানেন না অনুপ্রেরণার এ স্রোতের শেষ কোথায়? মৃত্যু নামক ঘটনাটি জাগতিক সবকিছু থামিয়ে দিলেও শিক্ষকের অনুপ্রেরণার যে স্রোত তা থামাতে পারেন না। তাইতো, প্রায়শই আমাদের আলোচনায় ওঠে আসে মরহুম অনেক শিক্ষকের প্রসঙ্গ। বিষয়টি পরিস্কার করার জন্যে দু একটা উদাহরণ টানা যাক। আমরা আধুনিক শিক্ষার জনক বলি সক্রেটিসকে। তাঁর দেহাবসান হয়েছে কতো হাজার বছর আগে। কিন্তু তাঁর চিন্তাধারা, দর্শন, শিক্ষা কি তাঁকে অমর করেনি ? খুব সাম্প্রতিক আমাদের আমাদের কাছ থেকে হারিয়ে যাওয়া একজন মানুষের উদাহরণ দিই। তিনি ভারতের মরহুম রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালাম। মাত্র আট বছর আগে ২০১৫ সালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। কিন্তু আমাদের আলোচনায় আমরা প্রায়ই তাঁর নানান শিক্ষা ও অনুপ্রেরণাদায়ক উক্তিগুলো আলোচনা করি। এভাবেই তিনি আমাদের মাঝে বেঁচে আছেন, আর এভাবেই শিক্ষকগণ শিক্ষার্থীদের হৃদয়ের জগতে অনুপ্রেরণার নদী হয়ে প্রবহমান থাকেন। এক্ষুনি এ পি জে আবদুল কালামের শিক্ষক সম্পর্কিত একটি উক্তি নিউরনে অনুরণন সৃষ্টি করছে। উক্তিটি লিখে মাথাটা একটু হালকা করি। তিনি বলেছেন, ” যদি কোন দেশ দুর্নীতিমুক্ত হয় এবং সবার মধ্যে সুন্দর মনের মানসিকতা গড়ে ওঠে,আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বিশ্বাস করি সেখানকার সামাজিক জীবনে তিন রকম মানুষ থাকবে,যারা পরিবর্তন আনতে পারেন। তারা হলেন – পিতা, মাতা ও শিক্ষক।”
আমার কেন জানি মাঝে মাঝে মনে হয়, শিক্ষকতা একটি শিল্প। শিক্ষকগণ মানুষ গড়ার শিল্পী। ছোটোখাটো নন,জগতের শ্রেষ্ঠ শিল্পী তাঁরা। এর প্রমাণ মেলে কবি ওমর খৈয়ামের নীচের কয়েকটি পঙতিতে—
ধূসর মরুর ঊষর বুকে
বিশাল যদি শহর গড়
একটি জীবন সফল করা
তার চাইতে অনেক বড়।
একজন শিক্ষক তাঁর শৈল্পিক কারুকাজ দিয়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মনের সরস মাটিতে
সুকুমার বৃত্তির বীজ বপন করেন। সে বীজ হতে নৈতিকতার চারা গজায়। সৃজনশীলতার ফুল ফোঁটে। জ্ঞানের ডাল পালা গজায়। ফলে দেশে তৈরি হয় সুনাগরিক, জাতি পায় কবি, সাহিত্যিক,লেখক, গবেষক, বৈজ্ঞানিক, প্রযুক্তিবিদ সহ নানান গুণের মানুষ। প্রকৃতপক্ষে শিক্ষকগণই মানব সন্তানের সুপ্ত মেধা এবং লুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটিয়ে থাকেন।
আমি শিক্ষকদের মনে করি জাতির ভবিষ্যত নির্ধারক। কেননা, “Education is the passport to future.” অতএব,শিক্ষকদের জাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারক বলা নিঃসন্দেহে অমূলক নয়। নীচের অনুচ্ছেদটির দিকে আলোকপাত করলে বিষয়টি যেন জলের মতো হয়ে যায় —
” Education is the backbone of the Nation. No Nation can prosper without education. Ignorance means darkness. So, the light of education is needed for the soceity.”
কালের আবর্তে সবকিছুই পরিবর্তনশীল। সে পরিবর্তন যদি হয় ইতিবাচক, উন্নতি, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির পথে ধাবমান তবেই জাতির কল্যাণ। এই ইতিবাচক পরিবর্তনের মূল নিয়ামক শক্তি শিক্ষক। এজন্যই বলা হয় –
A good teacher can change everything.
শিক্ষক মাত্রই মহানুভব। মহাত্মা। কারণ, অন্যের সন্তানকে মানুষ গড়ার জন্য, ভালো ফলাফল অর্জন করানোর জন্য যিনি নির্ঘুম রাত কাটান, শেষ রাত্রির প্রার্থনায় চোখের জল ঝড়ান তিনিই শিক্ষক। অন্যের সন্তানের সফলতায় মানব মনে হিংসার দানাবাঁধে। পক্ষান্তরে অন্যের সন্তানের সফলতায় যিনি সবচেয়ে বেশি খুশি হন,গর্ববোধ করেন তিনিই শিক্ষক।
কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, সেই বৃটিশ আমল থেকে আমাদের দেশে এ মহান পেশাটি নিগৃহীত। আমাদের শিক্ষকগণ ন্যায্য পাওনা বঞ্চিত। এখানে শিক্ষকের যোগ্যতা নিয়ে কটাক্ষ করা হয়। শিক্ষকদের প্রতি এই রাষ্ট্রীয় প্রবঞ্চনার কারণে শিক্ষকগণ আজকের সমাজে সবচেয়ে অবহেলিত। কেবল তাই নয়। আজ শিক্ষক কেবল প্রহৃত নয় খুনও হয় শিক্ষার্থীর হাতে। বছরখানেক আগে গাজীপুরে শিক্ষার্থী কর্তৃক শিক্ষক বধের ঘটনা তাই যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় আমাদের।
বোধহয় এজন্যই মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশা বিমুখ। কোন শিক্ষার্থীই শিক্ষক হওয়াকে জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করে না। এটা জাতির জন্য অশনি সংকেত।
মহান স্বাধীনত্র অর্ধ শতাব্দী পেরিয়ে গেলো আরো আগে। আমরা পারিনি শিক্ষকদের যথাযোগ্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতো। বিষয়টি শুধু লজ্জার নয়, নিন্দারও দাবি রাখে।
এ কথা স্বীকার না করে উপায় নেই যে, স্বাধীনতা পরবর্তী ৫৪ বছরে সবচেয়ে অবহেলিত পেশা শিক্ষকতা। এ বিষয়ে সম্প্রতি প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ ড. সলিমুল্লাহ খান বলেছেন, ” শিক্ষকদের বেতন দ্বিগুণ করে দিন,দশ বছরের মধ্যে এর সুফল পাবেন।
প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান স্যার বলেছেন – একটি বিদ্যালয় কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের মান কেমন হবে তা প্রধানত সেই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকের মানের উপরই নির্ভর করে। আর শিক্ষকের মান কেমন হবে তা প্রধানত শিক্ষকদের বেতন ও সম্মানের উপর নির্ভর করে। বাংলাদেশে শিক্ষকদের মান কেমন সেটা বুঝতে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের সাথে অন্যান্য ক্যাডারের তুলনা করলেই টের পাবেন।
তাই আমাদের দরকার সকল শ্রেণীর শিক্ষকের জন্য একটা উন্নত স্বতন্ত্র বেতন স্কেল। শুনলাম একজন সচিবের পাচক ভাতা ১৬০০০ টাকা যা একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের বেতনের চেয়ে ৫০০০ টাকা বেশি। Would you believe that? শুধু তাই না অষ্টম শ্রেণি পাশ সরকারি অফিসের গাড়িচালকদের বেতন ১২তম গ্রেডে আর স্নাতক পাশ প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন একধাপ নিচে ১৩তম গ্রেডে। তাহলে বুঝুন কেমন দেশে বাস করি। এই বৈষম্য কবে দূর হবে? বাংলাদেশের সকল সমস্যার মূল হলো শিক্ষা আর আমাদের সকল সরকার যুগ যুগ ধরে শিক্ষাকেই সবচেয়ে বেশি অবহেলা করে আসছে।
সকল বৈষম্যের অবসানের দৃপ্ত অঙ্গীকার নিয়ে গঠিত হয়েছে বতর্মান অন্তর্বতর্তীকালীন সরকার।
জাতি গভীরভাবে প্রত্যাশা করে বৈষম্যমুক্ত, মান সম্পন্ন শিক্ষা ব্যবস্থা এবার নিশ্চিত হবে। শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে জাতি বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।আমরা সে সুদিনের অপেক্ষায় রইলাম।
লেখক: কবি,প্রধান শিক্ষক
মীর নোয়াবুল হক মেমোরিয়াল হাই স্কুল।
হাটহাজারী পৌরসভা চট্টগ্রাম।