
বরগুনা জেলা প্রতিনিধি:
আজ ৩ ডিসেম্বর, বরগুনা হানাদারমুক্ত দিবস। মহান মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের মাত্র তেরো দিন আগেই ১৯৭১ সালের এই দিনে শত্রুমুক্ত হয় দেশের উপকূলীয় জেলা বরগুনা। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম শেষে এদিন ভোরের আলোয় বরগুনাবাসী প্রথম অনুভব করে স্বাধিকারের পূর্ণতা— পায় মুক্তির কাঙ্ক্ষিত স্বাদ।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বরগুনা ছিল ৯ নম্বর সেক্টরের বুকাবুনিয়া সাব-সেক্টরের অধীনে। প্রাথমিক পর্যায়ে মুক্তিকামী সহস্রাধিক স্থানীয় তরুণ বাঁশের লাঠি ও সীমিত সংখ্যক আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে প্রশিক্ষণ শুরু করলেও, পার্শ্ববর্তী পটুয়াখালী জেলা দখলের পর পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের আশঙ্কায় অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধা এলাকা ছেড়ে ভারতে প্রশিক্ষণের জন্য চলে যান।
এরপরই বরগুনায় শুরু হয় পাকিস্তানি হানাদারদের পৈশাচিক অধ্যায়। ১৯৭১ সালের ১৪ মে কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই বরগুনা শহর দখল করে নেয় পাকবাহিনী। দখলদারিত্বের পরপরই পাথরঘাটায় বিষখালী নদীর তীরে তারা নির্মম গণহত্যা চালায়। এর কিছুদিন পর, ক্যাপ্টেন শাফায়াতের নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনারা ২৯ ও ৩০ মে বরগুনা জেলখানায় প্রবেশ করে ৭৬ জন নিরপরাধ ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করে। নিহতদের গণকবর দেওয়া হয় জেলা কারাগারের দক্ষিণ পাশে।
মুক্তির জন্য গোপন প্রস্তুতি
দেশের অভ্যন্তরে যখন এমন বর্বরতা চলছিল, তখন দলে দলে তরুণরা ভারতে আধুনিক সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। প্রশিক্ষণ শেষে তাঁরা বুকাবুনিয়া সাব-সেক্টরের অধীনে সংগঠিত হন। বরগুনাকে মুক্ত করার চূড়ান্ত পরিকল্পনার নেতৃত্বে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সত্তার খান।
২ ডিসেম্বর দুপুরের দিকে আবদুস সত্তার খানের নেতৃত্বে বরগুনা ও ঝালকাঠির মোট ২১ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি বিশেষ দল বেতাগীর বদনীখালী নামক স্থানে অবস্থান নেয়। বরগুনার পরিস্থিতি তদারকির জন্য একজন সহকর্মীকে শহরে পাঠানো হয়। তাঁর কাছ থেকে সংকেত পাওয়ার পর গভীর রাতে একটি বড় বাচারী নৌকায় করে বিষখালী নদী পাড়ি দিয়ে দলটি বরগুনার উদ্দেশে রওনা হয়। রাত আনুমানিক তিনটার দিকে তাঁরা খাকদোন নদীর পোটকাখালী এলাকায় কৌশলগত অবস্থান গ্রহণ করেন। তাঁদের মূল লক্ষ্য ছিল: বরগুনায় অবস্থানরত পাকিস্তানি দোসর, রাজাকার ও পুলিশ সদস্যদের আত্মসমর্পণ করানো এবং জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ দখল করা।
মুক্তিযোদ্ধাদের সুচিন্তিত পরিকল্পনায় ফজরের আজানকে যুদ্ধ শুরুর সংকেত হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী, বরগুনা শহরকে কয়েকটি উপ-বিভাগে ভাগ করা হয়েছিল, যার মধ্যে ছিল কারাগার, ওয়াপদা কলোনী, জেলা স্কুল, সদর থানা ও এসডিওর বাসাসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো।
ভোরে আজান শুরুর সঙ্গে সঙ্গে ছয়টি ভিন্ন স্থান থেকে একযোগে প্রচণ্ড গোলাগুলি শুরু করেন মুক্তিযোদ্ধারা। হঠাৎ চারদিকে গুলির শব্দে পুলিশ ও রাজাকারদের মধ্যে চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। প্রথম দফার গোলাগুলির পর মুক্তিযোদ্ধারা অগ্রসর হন জেলখানা অভিমুখে। সেখানে অবস্থানরত পুলিশ ও রাজাকার সদস্যরা দ্রুতই অনুধাবন করেন যে মুক্তিযোদ্ধারা সংখ্যায় কম হলেও মনোবলে অপ্রতিরোধ্য। ফলস্বরূপ, তারা আত্মসমর্পণে বাধ্য হন।
আত্মসমর্পণকারী পুলিশ ও রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা এরপর তৎকালীন এসডিও (সাব-ডিভিশনাল অফিসার) কার্যালয়ে যান এবং এসডিও আনোয়ার হোসেনকেও আত্মসমর্পণ করান। দুপুরের মধ্যেই পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরদের সব নিয়ন্ত্রণ ভেঙে পড়ে। অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করে বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধারা ফিরে যান বুকাবুনিয়া সাব-সেক্টর হেডকোয়ার্টারে।
এভাবেই বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর বরগুনা জেলা সদর শত্রুমুক্ত হয়। বরগুনার সাংবাদিক ও মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন মনোয়ারের দেওয়া তথ্যমতে, বরগুনা সদর মুক্ত হওয়ার আগেই ২৪ নভেম্বর বামনা (তৎকালীন একটি এলাকা, পরে উপজেলায় রূপান্তরিত) হানাদারমুক্ত হয়। এছাড়া আমতলী ও তালতলী উপজেলা শত্রুমুক্ত হয় বিজয়ের মাত্র দুদিন আগে, ১৪ ডিসেম্বর।
























