
আব্দুর রহিম শাওন,
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম পীর সাহেব চরমোনাই ২৪-এর জুলাইর এই দিনে যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের জান্নাতে সর্বোচ্চ মর্যাদা কামনা করেন এবং সেই সাথে যারা চক্ষু হারিয়েছে, আহত হয়েছে, চিরতরে পঙ্গুত্ববরণ করেছেন তাদের পরিপূর্ণ চিকিৎসা ও সুস্থতা কামনা করেন।
মঙ্গলবার (৫ আগস্ট) সকালে রাজধানীর বায়তুল মোকাররম উত্তর গেইটে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আয়োজিত ‘জুলাই অভ্যুত্থানের প্রথম বর্ষপূর্তি উদযাপন’ উপলক্ষে দিনব্যাপী আয়োজনে প্রথম পর্বের গণসমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি আরও বলেন, আয়না ঘরের কারিগর, গুম-খুন, হত্যার দোসর খুনি হাসিনা ২৪-এর এই দিনে দেশ থেকে পালাতে বাধ্য হয়েছে। দেশের টাকা যারা বিদেশে পাচার করেছে, তাদের উৎখাতে ছাত্র-জনতা যখন দেশের সকল অলিগলিতে আওয়াজ তুলেছিল, আবু সাঈদ দু’হাত উঠিয়ে বুক পেতে দিয়েছিল, এমনকি মা-বোনেরা পর্যন্ত রাস্তায় নেমেছিল, তখন মুগ্ধের ‘পানি লাগবে’ সেই আওয়াজ এখনো কানে ভাসে। এতো ত্যাগ, এতো রক্ত, এতো জীবন দেয়ার মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ছিল আর কোন স্বৈরাচার, ফ্যাসিস্ট, টাকা পাচারকারী, আয়নাঘর তৈরির কারিগরের জন্ম যেন না হয়। আমরা ঘৃণাভরে ধিক্কার জানাই সে সকল ক্ষমতা লোভীদের, যারা চাঁদাবাজির মাধ্যমে, স্ট্যান্ড দখল, জায়গা দখল করে নতুনভাবে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার চেষ্টায়রত।
তিনি আরো বলেন, তারা কী শিশুদের আত্মচিৎকার শুনতে পায়নি? হাজার হাজার মায়ের কোল খালি হয়েছে, হাজারো মেধাবী ছাত্ররা শহীদ হয়েছে, পূর্বের বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার জন্য? যারা বিগত দিনে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে, তাদেরকে দেশবাসী পুনরায় ক্ষমতায় দেখতে চায় না। মুফতী রেজাউল করীম বলেন, এদেশ আমার, এদেশকে সুন্দর করার দায়িত্বও আমার। আসুন সবাই মিলে সন্ত্রাস, দুর্নীতিবাজ, চাঁদাবাজদের উৎপাত করি। বিদেশী তাঁবেদারদের চিরতরে কবর রচনা করতে করি। সবাই একাকার হয়ে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে নতুন করে সাজাই।
সংগঠনটির যুগ্ম মহাসচিব ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ সভাপতি মাওলানা মুহাম্মদ ইমতিয়াজ আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন, দলের মহাসচিব অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা ইউনুছ আহমাদ। বক্তব্য রাখেন, দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন, যুগ্ম মহাসচিব ও দলের মুখপাত্র মাওলানা গাজী আতাউর রহমান, যুগ্ম মহাসচিব ও ঢাকা মহানগর উত্তর সভাপতি প্রিন্সিপাল হাফেজ মাওলানা শেখ ফজলে বারী মাসউদ, মাওলানা এবিএম জাকারিয়া, বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেম, মুফতী রেজাউল করীম আবরার, আলহাজ্ব আলতাফ হোসেন, আলহাজ্ব আনোয়ার হোসেন, মাওলানা মুহাম্মদ আরিফুল ইসলাম, আব্দুল আউয়াল মজুমদার, ছাত্রনেতা মুনতাসির আহমদ, মুফতী ফরিদুল ইসলাম, মুফতী মাছউদুর রহমান, যুবনেতা হাম্মাদ বিন মোশাররফ, শ্রমিকনেতা হাফেজ শাহাদাত হোসেন প্রধানিয়া। সমাবেশ সঞ্চালনায় ছিলেন মাওলানা কেএম শরীয়াতুল্লাহ, ইঞ্জিনিয়ার মুরাদ হোসেন। উপস্থিত ছিলেন, সহকারী মহাসচিব মাওলানা আহমদ আবদুল কাইয়ুম, মুফতী কেফায়েতুল্লাহ কাশফী, আলহাজ্ব মনির হোসেন, আমিরুল হক, হাফেজ মাওলানা ইউনুছ ঢালী।
এসময় দলের মহাসচিব অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা ইউনুস আহমদ সেখ বলেন, ১ বছর পূর্বে শত শত মানুষ শহীদ হয়েছিলো, মানুষের চোখের পানি ঝড়েছিল, স্বপ্ন ছিলো একটি সুন্দর, স্বাধীন বাংলাদেশের। আমরাও আশাবাদী ছিলাম, যারা শাহাদাত বরণ করেছে, তাদের ক্ষমতার লোভ ছিলো না, পদের লোভ ছিলো না। তাদের চাওয়া ছিলো দেশের মানুষ যেন ভাল থাকে। আসুন সবাই মিলে দেশটাকে ভালভাবে গড়ি। কিছু মানুষ চাচ্ছে, দ্রুত চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিকে বৈধতা দেয়ার জন্য। ফ্যাসিস্টদের প্রেতাত্মাদের মধ্যে পিআর-এর কোন অনুভুতি জাগ্রত হয় না। সংস্কার ও গণহত্যার বিচার তারা চায় না। তিনি পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের মাধ্যমেই কেবল দেশকে নতুনভাবে গড়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
অনুষ্ঠানে অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন বলেন, জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে জনআকাঙ্খার সঞ্চার হয়েছে। পীর সাহেব চরমোনাই’র নেতৃত্বে রাষ্ট্রের আমূল পরিবর্তন হবে। মানুষের ভোট ও ভাতের অধিকার নিশ্চিত হবে। সাধারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়ার প্রতিফলন ঘটবে।
মাওলানা গাজী আতাউর রহমান বলেন, বিগত ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ব্যর্থতার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে অনুতপ্ত হওয়া উচিত। সব রাজনৈতিক দল মিলেও ফ্যাসিবাদী ও খুনি হাসিনাকে পদচ্যুত করা যায়নি। কিন্তু ছোট ছোট ছাত্ররা তাদের জীবনের বিনিময়ে দেশকে ফ্যাসিবাদমুক্ত করেছে। সকল কৃতিত্ব ছাত্র-জনতার। আজ যারা ছাত্রদের আন্দোলনকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করছে, তাদের উদ্দেশ্য কেবলই ক্ষমতা। তিনি বলেন, বিগত ফ্যাসিবাদী সরকার বলেছিলো তারা ক্ষমতা ছাড়লে দেশ চালানোর কোন উপযুক্ত লোক নেই। ক্ষমতা ছাড়লে প্রথমদিনেই ২ লাখ মানুষ মারা যাবে। কিন্তু আমরা দেখলাম এমন কিছুই ঘটেনি। বর্তমান সরকার দেশ ভালই চালিয়েছে। মানুষও মারা যায়নি। তবে তারা যেহেতু রাজনৈতিক ব্যক্তি নয়, তাই সামান্য ভুল-ভ্রান্তি হতেই পারে। সেনাবাহিনী প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অনেকে সেনাবাহিনীর ক্যু’র কথা বলছেন। সেনাবাহিনী সেদিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছেন। দেশপ্রেমের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। একটি দল পিআর চাচ্ছে না। প্রশাসন, আইন ও নির্বাচন কমিশন সংস্কার করতেই হবে। অন্যথায় নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের জনআকাঙ্খার পুরণ হবে না।
প্রিন্সিপাল হাফেজ মাওলানা শেখ ফজলে বারী মাসউদ বলেন, জুলাই আন্দোলনের আমাদের মিছিলে সরাসরি গুলি করে আমাদেরকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিলো ফ্যাসিবাদী হাসিনা। আমরা জীবনের মায়া ত্যাগ করে ফ্যাসিবাদমুক্ত দেশগড়ার আন্দোলন গড়ে তুলেছি পুনরায় ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য নয়। তিনি ছাত্র-জনতার চাওয়া পাওয়া বৈষম্যহীন কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান আহ্বান জানান।
সভাপতির বক্তব্যে মাওলানা ইমতিয়াজ আলম বলেন, ভোট ও ভাতের অধিকারের জন্য এবং খাদ্য, বস্ত্র ও চিকিৎসার মৌলিক অধিকারের জন্য জুলাই বিপ্লবে ছাত্র-জনতা জীবন দিয়েছে। যারা দুর্নীতিতে বার বার চ্যাম্পিয়ান হয়েছে, তারা পরীক্ষিত শোষক ও জালেম। তাদের আমলেও মানুষ স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারেনি। এরশাদ, হাসিনা ও খালেদা সবাইকেই রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করতে হয়েছে।
সমাবেশ শেষে একটি বিশাল গণমিছিল পীর সাহেব চরমোনাই’র নেতৃত্বে বায়তুল মোকাররম, পল্টন মোড়, প্রেসক্লাব কদম ফোয়ারা হয়ে শাহবাগ মোড়ে গিয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য ও মুনাজাতের মাধ্যমে সমাপ্ত হয়। বেলা ২.৩০ টা থেকে জুলাই বিপ্লবের ডকুমেন্টরী প্রদর্শণ এবং জাতীয় সাংষ্কৃতিক সংগঠন কলরব, মানযিল, সুরের তরীর বরেণ্য শিল্পীদের কন্ঠে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সবশেষে সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত জুলাই যোদ্ধাদের স্মরণে বিশেষ দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়। এতে দেশবরেণ্য উলামায়ে কেরাম আলোচনা করেন।