
মাকসুদুল হোসেন তুষার স্টাফ রিপোর্টার
কথিত একটি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাত্র সাত জন শিক্ষার্থী নিয়ে পাঠ দানের অনুমতি পেয়েছে। এখন শিক্ষা বোর্ডের স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য মাঠে নেমেছে একটি অসাধু ও স্বার্থান্বেষী চক্র। ২০০৪ সালে খাতা কলমে স্থাপিত এ বিদ্যালয়টি অনিয়মের মাধ্যমে পাঠ দানের অনুমতি পেয়েছে। পাশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যখন কাম্য সংখ্যাক শিক্ষার্থী সংকটে ভুগছে তখন এ প্রতিষ্ঠানটি কিভাবে স্বীকৃতি পাবে তা এলাকাবাসিকে ভাবিয়ে তুলেছে।
বিভিন্ন সূত্রে জানাগেছে, বাঘারপাড়া উপজেলার বাসুয়াড়ি ইউনিয়নের আয়াপুর গ্রামে ২০০৪ সালে স্থাপিত হয় আরডিকে আয়াপুর নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়। রোস্তমপুর, দেবিনগর ও কৈখালীর সংক্ষিপ্ত রুপ হচ্ছে আরডিকে। স্থাপিত হওয়ার পর থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১০ জন শিক্ষার্থীও জোগাড় করতে পারেনি এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি। যে কারণে এ প্রতিষ্ঠানটি না পেয়েছে পাঠ দানের অনুমতি, না পেয়েছে স্বীকৃতি। ২০২২ সালের অক্টোবরে প্রতিষ্ঠানটি শিক্ষা মন্ত্রনালয় থেকে পাঠ দানের অনুমতি ও একাডেমিক স্বীকৃতি লাভ করে। অথচ গত ১৮ বছর ধরে প্রতিষ্ঠানের কোন কার্যক্রমই চলেনি। একটি সূত্রের দাবি পাঠ দানের অনুমতির ক্ষেত্রে কোন নিয়মই মানা হয়নি। কথিত ঐ প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষকের বড় ভাই এনটিআরসি’র চেয়ারম্যান মফিজুর রহমানের তদবিরে কোন নিয়ম না মেনেই পাঠ দানের অনুমতি ও একাডেমিক স্বীকৃতি দেয় শিক্ষা মন্ত্রনালয়। গত দুই বছর ধরে এ প্রতিষ্ঠানের উপর ভর করেছে যশোর সদরের রায়মানিক কচুয়ার একটি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়। এ নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি এখনও পাঠ দানের অনুমতি পায়নি। যে কারণে এ বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থীদের রেজিষ্ট্রেশন করানো হয় আরডিকে আয়পুর নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নামে। খাতা কলমে কিছু সংখ্যাক শিক্ষার্থী হওয়াতে এর উপর ভর করে যশোর শিক্ষা বোর্ড থেকে বিদ্যালয়ের স্বীকৃতি লাভের জন্য জোর তৎপরতা চালাচ্ছে ঐ চক্র। গত ১৮ মে যশোর শিক্ষা বোর্ড কথিত বিদ্যালয়টি পরিদর্শন করেছে। এ দিন রায়মানিক কচুয়া নি¤œ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থীকে ভাড়া করে আনা হয় এ বিদ্যালয়ে।
সরেজমিনে গিয়ে জানাগেছে, বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার জন্য ২০০৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ৬১ শতক জমি নিরুপন দলিলের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের নামে দান করেন আয়াপুর গ্রামের গোলাম রসুল। জমির পরিমান কম হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটি কোন কার্যক্রম করতে পারেনি। গ্রাম বাসির অনুরোধে ২০১২ সালের ৫ জুলাই আরো ১৩ শত জমি বিদ্যালয়ের নামে একই পন্থায় দলিল করে দেন গোলাম রসুল। উভয় দলিলই করা হয় শিক্ষা সচিব, বাঘারপাড়ার নামে। অথচ উপজেলা পর্যায়ে শিক্ষা সচিব নামে কোন পদই নেই। নিরুপন দলিলের অর্থ হচ্ছে ঐ জমিতে যদি প্রতিষ্ঠান করতে ব্যার্থ হয় তাহলে জমির মালিকানা পূর্বের মালিকের কাছে ফিরে আসবে। বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার নুন্যতম নীতিমালা প্রতিপালিত না হওয়ায় ও প্রস্তাবিত বিদ্যালয়টি দীর্ঘদিন যাবৎ প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় গোলাম রসুল জমি ফেরত চায়লে নানা তালবাহানা শুরু করে কথিত প্রধান শিক্ষকসহ ঐ চক্রটি। এক পর্যায়ে গোলাম রসুল আদালতে দেওয়ানী মামলা করে। মামলা নং ৪২৩/২১। আদালত গোলাম রসুলের পক্ষে ২৭/০৩/২০২২ তারিখে রায় প্রদান করে। আদালতের রায় পাওয়ার পর গোলাম রসুল ঐ জমিতে দখল নেওয়ার চেষ্টা করে। এ সময়কার ক্ষমতাসীনরা গোলাম রসুলের বিপক্ষে থাকায় দখল নিতে ব্যর্থ হয়। ২০২৪ সালের আগষ্টে রাজনৈতিক পেক্ষাপট পরিবর্তন হলে বিএনপি পন্থীরা ঐ বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। যে কারণে ঐ জমি দখল নিতে আবারও বেকায়দায় পড়েছে গোলাম রসুল।
প্রতিষ্ঠানটি শিক্ষা মন্ত্রনালয় থেকে পাঠ দানের অনুমতি ও একাডেমিক স্বীকৃতি পাওয়ার পর গোলাম রসুল এর বিরদ্ধে আদালতে মামলাও করেন। মফস্বল এলাকায় একটি নি¤œ মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আবশ্যকীয় শর্তবলীর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, প্রস্তাবিত বিদ্যালয় হতে অন্য মাধ্যমিক বা নি¤œ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দুরত্ব হতে হবে কম পক্ষে তিন কিলো মিটার। অথচ মাত্র তিনশত গজ দুরে রয়েছে মাহমুদপুর সিএসসি নি¤œ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়। এ বিদ্যালয়টি কাম্য সংখ্যাক শিক্ষার্থী সংকটে ভুগছে দীর্ঘ দিন ধরে। এ বিদ্যালয়ে তিনটি শ্রেণীতে একশত বিশজন শিক্ষার্থী থাকার নিয়ম থাকলে খাতা কলমে আছে মাত্র ৭৩ জন। গত মঙ্গলবার সরে জমিনে মাহমুদপুর সিএসসি নি¤œ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায় তিনটি শ্রেণীতে শির্ক্ষীর উপস্থিতি মাত্র ৪৫ জন। প্রশ্ন উঠেছে তিনশত গজ পাশেই আরডিকে আয়াপুর নি¤œ মাধ্যমিক বিদ্যালয় তাহলে শিক্ষার্থী পাবে কোথায়। প্রস্তাবিত বিদ্যালয় থেকে মাত্র এক কিলো মিটার দুরে রয়েছে চাড়াভিটা মাধ্যমিক বিদ্যালয়। আড়াই কিলো মিটার দুরে রয়েছে ছাতিয়ানতলা মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও ছাতিয়ানতলা বালিকা বিদ্যালয়। দেড় কিলো মিটার দুরে রয়েছে মাহমুদপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়, দুই কিলো মিটার দুরে রয়েছে মামড়াখোলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়, এক কিলো মিটারের মধ্যে রয়েছে মাহমুদপুর আকবর আলী বালিকা দাখিল মাদ্রাসা ও মাহমুদপুর দাখিল মাদ্রাসা। এ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রায় সব গুলো কাম্য সংখ্যাক শিক্ষার্থী সংকটে ভুগছে।
সরে জমিনে গত মঙ্গলবার মাহমুদপুর আকবর আলী বালিকা দাখিল মাদ্রাসা গিয়ে দেখা গেছে পাঁচটি শ্রেণীতে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি মাত্র ৪৫ জন। একই অবস্থা মাহমুদপুর আলীম মাদ্রাসার ক্ষেত্রে। এ মাদ্রাসাতেও মোট শিক্ষার্থীর উপস্থিতি ছিলো মাত্র ২৭ জন। প্রস্তাবিত বিদ্যালয় এলাকার নুন্যতম জন সংখ্যা হতে হবে আট হাজার। অথচ ঐ চার গ্রামের জন সংখ্যার পরিমান মাত্র সাড়ে তিন হাজার।
এ বিষয়ে গোলাম রসুল জানিয়েছেন, কোন প্রকার সুবিধা ছাড়াই তিনি ৭৪ শতক জমি বিদ্যালয়ের নামে লিখে দিয়েছিলেন। দীর্ঘ ২১ বছরে প্রতিষ্ঠানটি আলোর মুখ দেখেনি। যে কারণে গোলাম রসুল তার সম্পত্তি ফেরত পাওয়ার জন্য সরকারের সব মহলে জানিয়েও কোন প্রতিকার পাচ্ছেন না। সর্বশেষ একটি মহল জোর করে তার জমির উপর ভবন নির্মান করার চেষ্ঠা করছেন। এ বিষয়ে গোলাম রসুল আদালতের শরনাপন্ন হলে সেখানে আদালত ১৪৪ ধারা জারি করে। স্বার্থান্বেসী মহল আদালতের আদেশ অমান্য করেই সেখানে নির্মান কাজ অব্যাহত রেখেছেন।
আরডিকে আয়াপুর নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাত্র তিনশত গজ দুরে অবস্থিত মাহমুদপুর সিএসসি নিম্ন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়। কথা হয় এ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাসুদুর রহমানের সাথে। তিনি জানান, তার বিদ্যালয়টি ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত। দীর্ঘ ২৬ বছরে তাদের কাম্য শিক্ষার্থীর ৬০ ভাগ পুরণ হয়েছে। নীতিমালা অনুযায়ি এ বিদ্যালয়েরই এমপিও থাকার কথা না। সেখানে ঐ প্রতিষ্ঠান কিভাবে চলবে সেটাই ভাবার বিষয়।
মাহমুদপুর আকবর আলী বালিকা দাখিল মাদ্রাসার সুপার আব্দুস সালাম জানিয়েছেন, শিক্ষার্থীর অভাবে তার প্রতিষ্ঠানের অবস্থা নিভু নিভু। আশেপাশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো হয়েছে নিয়ম বর্হিভুতভাবে। যে কারনে সব প্রতিষ্ঠানেই কাম্য সংখ্যাক শিক্ষার্থী নেই। শিক্ষা বোর্ড আরডিকে আয়াপুর নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের স্বীকৃতি দিলে বুঝবো এ দেশ আর কোন দিনই ভালো হবে না।
বাঘারপাড়া উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) আশিকুজ্জামান বলেন, ঐ বিদ্যালয়ের তদবীর করছেন বড় চেয়ারের লোক। ফলে আমি কোন মন্তব্য করতে পারবো না।
আরডিকে আয়াপুর নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের কথিত প্রদান শিক্ষকের মুঠো ফোনে(০১৭১৪৪৭৮৯০৪) যোগাযোগের কয়েকবার চেষ্টা করা হয়েছে। ফোনে রিং বাজলেও তিনি তা রিসিভ করেননি।
গত ১৮ মে কথিত এ প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে আসেন যশোর শিক্ষা বোর্ডের উপ বিদ্যালয় পরিদর্শক ডালিম হোসেন। তিনি জানিয়েছেন, সরেজমিনে সব কিছু দেখা হয়েছে। বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষিতে মতামত প্রদান করা হবে। বিষয়টি মঞ্জুরী বোর্ডে উত্থাপিত হবে। বোর্ড যে সিদ্ধান্ত নেবে তাই হবে।