বিশেষ প্রতিবেদক।।
বরিশালের রূপাতলী থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পার হয়ে দক্ষিণে ঝালকাঠির নলছিটি জিরো পয়েন্ট- পশ্চিমে ঝালকাঠি সড়কের কালিজিরা ব্রীজ এবং পূর্বে ভোলা রোডের কিছু অংশসহ প্রায় ৯ কিলোমিটার সড়কে দাঁড়িয়ে আছে হাজারো পরিবহন। সকাল ৯টা থেকে বরিশাল কুয়াকাটা সড়কে এভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে বাস-ট্রাক-মাইক্রোবাস- প্রাইভেট কার- মহেন্দ্র ইত্যাদি সব জাতীয় যান। যাত্রীবাহী যানবাহনের ভিতর থেকে নেমে যাত্রীদের কেউ কেউ হাঁটা শুরু করেছেন। কেউ কেউ ভাড়া ফেরত চেয়ে ঝগড়া করছেন গাড়ি চালকের সাথে। আবার গাড়ির দীর্ঘ সাড়ি ঠেলে শতশত মানুষের পায়ে হাঁটা দৃশ্য দেখে মনে হতে পারে এ যেন কোনো শোক মিছিল। এই মিছিলে রয়েছে নারী-শিশু ও বয়বৃদ্ধের করুন আহাজারি। সবাই বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অভিসম্পাত করছেন। কেউ কেউ বলছেন এই বিশ্ববিদ্যালয় সরিয়ে নিতে নয়তো সড়ক সরিয়ে নিতে। অবস্থা বেগতিক দেখে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনা করার চেষ্টা করেন সেনাবাহিনীর মেজর গনি। নারী ও শিশুদের কান্নার দোহাই দিয়ে সড়ক অবরোধ তুলে নিতে বলেন তিনি। কিন্তু একরোখা ছাত্রদের বোঝানো কার সাধ্যি। তাদের দাবীও যৌক্তিক। প্রশাসনের কাছে তারা নির্দিষ্ট সময়ের ভিতর ঘাতক বাসের চালক ও হেলপারকে আটক করে শাস্তি নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি চান। মাইশা ফৌজিয়া মিম এর হত্যার ন্যায়বিচার ও ক্ষতিপূরণ চান তারা।
হাঃ এটাই ঘটেছিলো গত ৩০ অক্টোবর রাত ৯টার দিকে। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ভোলা সড়কের মোড়ে বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়কে রাস্তা পারাপারের সময় বাস চাপায় মাইশা ফৌজিয়া মিম নামের ছাত্রী নিহত হয়েছেন। নিহত মাইশা বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। বুধবার রাত সোয়া ৯টার দিকে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়ক পার হচ্ছিলেন। এ সময় নারায়ণগঞ্জ পরিবহন নামে কুয়াকাটা থেকে আসা একটি বাস তাঁকে চাপা দেয়। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বাসটি প্রথমে তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়, পরে তার উপর দিয়ে চালিয়ে যায় চালক। আশেপাশের শিক্ষার্থী ও পথচারী তাঁকে উদ্ধার করে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় ক্ষীপ্ত হয়ে শিক্ষার্থীরা বাসটিকে জব্দ করলেও এর চালক ও সহকারী পালিয়ে যায়। বাসটির নাম্বার ঢাকা মেট্রো- ব ১২:২২১৩। চালকের নাম মো: জমির হোসের। তার ড্রাইভিং নাম্বার PK0004780L00009। পরে শিক্ষার্থীরা বাসটিতে আগুন ধরিয়ে দেন এবং মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। এ কারণে গত বুধবার রাত একটা পর্যন্ত বরিশাল কুয়াকাটা মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ ছিল। প্রশাসনের আশ্বাসে শিক্ষার্থীরা রাতের অবরোধ তুলে নেয়।
বৃহস্পতিবার সকাল থেকে শিক্ষার্থীরা পুনরায় মহাসড়কে জড়ো হতে শুরু করেন। সারারাত কেটে যাওয়ার পরও বাসচাপায় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী মাইশা ফৌজিয়া নিহত হওয়ার ঘটনায় অভিযুক্ত বাসচালক ও তার সহযোগী কে আটক করতে পারেনি পুলিশ বা প্রশাসন। তাই তারা পুনরায় চালক ও হেলপারকে গ্রেপ্তারের দাবিতে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে মহাসড়কে অবস্থান নেন। সকাল সাড়ে এগারোটায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের সামনে নিহত মাইশার জানাজার পর লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। মাইশা বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার বাড়ি ঢাকায়। ঢাকা থেকে বরিশালে পড়তে এসে লাশ হয়ে ফিরে গেলেন মাইশা। একটি এম্বুলেন্সে তাদের পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এর আগে সকাল ১০টার দিকে শিক্ষার্থীরা আবার বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন। এতে যান চলাচল ৯ কিলোমিটার এলাকায় দীর্ঘ লাইন তৈরি হয় এবং যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। কয়েকজন শিক্ষার্থী তখন বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে জরুরী সেবা পরিবহন চলাচলের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছিলেন। এসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সুজয় শুভ বলেন, বাসচালককে গ্রেপ্তারে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের কোনো ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়ে তাঁরা আবার সড়কে নেমেছেন। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত অবরোধ অব্যাহত থাকবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর রাহাত হোসাইন ফয়সাল বলেন, ‘পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে যে খুব দ্রুত বাসচালক ও মালিকপক্ষকে আইনের আওতায় আনা হবে। আমরা শিক্ষার্থীদের অনুরোধ করব, তারা যেন একটু ধৈর্য ধরে।’
এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত অবরোধ চলমান রয়েছে।
বেলা দেড়টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শিক্ষার্থীদের সাথে বৈঠক শেষে সড়কে এসে দাঁড়িয়ে ব্যানার নিয়ে নিজেই এই দূর্ঘটনার প্রতিবাদ জানান। এসময় উপাচার্য অধ্যাপক ড শূচিতা শরমিন বলেন, আমরা এরই মধ্যে বিআরটিএ এর সঙ্গে কথা বলেছি। তারা পাঁচ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেবে। আমরা সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা বলছি। যতদ্রুত সম্ভব আমরা ঐ খুনি বাস চালককে গ্রেপ্তারের জন্য কথা বলেছি। বাস মালিককে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে আসবো।