
নবাবগঞ্জ (ঢাকা) প্রতিনিধি:
ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার মহাকবি কায়কোবাদ কন্যা জাহানারা বেগম প্রতিষ্ঠিত বক্সনগর উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালনায় ব্যাপক দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ উঠেছে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ শফি উদ্দিনের বিরুদ্ধে গোপনে গাছ বিক্রয়, জমি এওয়াজ বদল চেষ্টা, বিনা রশিদে রেজিস্ট্রেশন ফি আদায়, সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনসহ বিভিন্নভাবে প্রায় কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।
বিদ্যালয় সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ ও তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনে উঠে আসে এসব চিত্র। অন্যদিকে বিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা উপজেলা প্রশাসনে লিখিত অভিযোগ করেও কোন রকমের প্রতিকার পাচ্ছেন না বলে তারা জানিয়েছেন।
অবৈধ পন্থায় সভাপতি পরিবর্তন;
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, ২০১৩ সালে প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ শফিউদ্দিন বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। ২০১৫ সালে প্রধান শিক্ষক জাল রেজুলোশন দুর্নীতিতে ধরা পড়েন। সে সময়ে বিদ্যালয়ের সভাপতি এ ই আব্দুল মুনিম এবিষয়ে প্রতিবাদ করেন। এতে প্রধান শিক্ষক ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন। ফন্দি আটেন সভাপতিকে বিদ্যালয় থেকে বাদ দেয়ার। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা সত্তে¡ও অনিয়ম করে অনুমোদন বিহীন প্রাথমিক শাখার দুই ভোট যুক্ত করেন। পরে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অভিভাবক ও একজন খন্ডকালীন শিক্ষককের ভোটের মাধ্যমে ম্যানেজিং কমিটির সাজানো নির্বাচন করা হয়। অবৈধভাবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের খন্ডকালীন শিক্ষক সূচনা আক্তার ও অভিভাবক প্রতিনিধি মনোনয়ন দিয়ে সাজানো নির্বাচনের মাধ্যমে এই আব্দুল মুনিমকে সভাপতি পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে আলহাজ¦ আব্দুল বাতেন মিয়াকে সভাপতি করা হয়।
গোপনে গাছ কেটে অর্থ আত্মসাৎ;
প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ শফি উদ্দিন বিদ্যালয়ের জায়গা হতে বিভিন্ন সময়ে অবৈধভাবে গাছ বিক্রি করার অভিযোগ রয়েছে। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানের নিকট দেয়া পত্রে দেখা যায়, এ পর্যন্ত বিভিন্ন জাতের ৭৭টি গাছ বিক্রয় করা হয়েছে। যার আর্থিক বাজার মূল্য প্রায় ২০-২৫ লক্ষ টাকা। সেখান থেকে মাত্র লক্ষাধিক টাকা বিদ্যালয় তহবিলে জমা দিলেও বাকি টাকা আত্মসাত করা হয়েছে বলে অভিযোগ। গাছ বিক্রিতে ম্যানেজিং কমিটির সিদ্ধান্ত নেই, বণ বিভাগের কোন অনুমোদন নেই বলেও অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে। সর্বশেষ ২০২৪ সালের জুলাই মাসে কারফিউ চলাকালীন গাছ বিক্রয় করা হয়। দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশের মধ্যে গাছ কাটার কারণে কোন প্রচার বিজ্ঞপ্তি ছিল না। ৫ আগষ্ট পরবর্তী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর ‘গাছ বিক্রয়’ দুর্নীতির বিষয় এলাকাবাসীর সামনে চলে আসে। ফলে বিষয়টি ছাত্র/ছাত্রী ও এলাকাবাসীর মাঝে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। বিক্ষুদ্ধ এলাকাবাসী প্রধান শিক্ষকের পদত্যাগের দাবীতে মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল করে। এরপর তার বিদ্যালয়ে আসা বন্ধ হয়ে যায়। পরে এলাকাবাসীর চাপে ১১টি গাছ বিক্রির টাকা বিদ্যালয় তহবিলে জমা করা হয় বলে জানা যায়।
বিনা রশিদে অতিরিক্ত অর্থ আদায়;
২০২৩ সালে ছাত্র-ছাত্রীদের সরকারি রেজিস্ট্রেশনের টাকা আদায় করা হয় বিনা রশিদে। ষষ্ঠ শ্রেণি হতে সরকারি ফি ৫৮ টাকার স্থলে ৫০০ টাকা, অষ্টম শ্রেণি ৭৪ টাকার স্থলে ৬০০ টাকা, নবম শ্রেণি ১৭১ টাকার স্থলে ৬০০ টাকা আদায় করা হয়। সেসময়ে অতিরিক্ত ফি আদায়ের বিষয়ে ছাত্র/ছাত্রীদের কোন রশিদ দেয়া হয়নি। একই বছর ষান্মাষিক ৩০০ টাকা এবং বার্ষিক ৪০০ টাকা মূল্যায়ন ফি বিনা রশিদে আদায় করা হয়। ঠিক এভাবে প্রতি বছর জেএসসি ও এসএসসি উত্তীর্ণ ছাত্র/ছাত্রীদের কাছ থেকে টেস্টিমোনিয়াল বাবদ ৫০০ টাকা ও বোর্ড সনদ বিতরণ বাবদ ৫০০ টাকা আদায় করা হয়। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ টাকা বিনা রশিদে আদায় করা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছেন। একই বছর এসএসসি পরীক্ষার্থীদের নিকট হতে কোচিং ফি এবং জরিমানা বাবদ অগ্রিম হিসেবে ৬ হাজার টাকা একত্রে আদায় করা হয়। এছাড়াও প্রতি বছর নির্বাচনী পরীক্ষায় অকৃতকার্যদের নিকট হতে বিষয়প্রতি ১০০ টাকা বিনা রশিদে আদায় করা হয় বলে প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে।
জমি হস্তান্তরের চেষ্টা;
আব্দুল বাতেন মিয়ার ম্যানেজিং কমিটিও দুর্নীতিতে পিছিয়ে ছিলো না। ২০২২ সালে প্রধান শিক্ষকের যোগসাজসে অর্থের বিনিময়ে বিদ্যালয়ের জায়াগার মাঝখান দিয়ে পারিবারিক রাস্তা দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, সে সময়ে স্থানীয় মো. তাহেরুল ইসলাম টুটুলের জায়গা এওয়াজ বদলের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আব্দুল বাতেন মিয়ার কমিটি। প্রধান শিক্ষককের বাসভবনের কাছে রাস্তার সাথের বিদ্যালয়ের জায়গা নিয়ে পিছনের কম মূল্যের জায়গা এওয়াজ বদলের পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু আইনী জটিলতার কারণে এওয়াজ বদল করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে বিদ্যালয়ের জায়গার মাঝখান দিয়ে রাস্তা দিয়ে বিষয়টির সমাধান করা হয়।
অন্যান্য দুর্নীতি;
প্রধান শিক্ষকের যোগসাজসে ২০১৭ সালে বিদ্যালয়ের “সুবর্ণ জয়ন্তী” উদযাপনে তহবিলে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। ২০২৪ সালে বিদ্যালয়ের উত্তর পাশের সেমি পাকা ভবন বিক্রয়ে সর্বোচ্চ দরদাতার মূল্য ছিল ৩ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা। কিন্তু বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটি তাদের পছন্দের লোককে ২ লাখ ৩০ হাজার টাকায় হস্তান্তর করে দেয়। বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির প্রাক্তন সভাপতি মরহুম এই আব্দুল মুনীম এবং তাঁর স্বীয় ভাইগণ কর্তৃক তাছাড়া বিদ্যালয়ের অনুকূলে দানকৃত সম্পত্তির হিসাব এলাকাবাসীর নিকট গোপন রাখা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শিক্ষক জানান, ২০২৪ সালে নির্বাচনী পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে অনিয়ম করা হয়েছে। পূর্বের বছরগুলোতে খাতায় কোডিং নাম্বার দেওয়ার পর ছাত্র-ছাত্রীর পরিচিত অংশ বিচ্ছিন্ন করে মূল্যায়ন করা হতো। এবছর অজ্হাত কারণে প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষক প্রতিনিধি লিপিকা সাহা নির্বাচনী পরীক্ষার খাতা কোডিং, স্ক্রুটিং করতে দেননি। শিক্ষার্থীর পরিচিতি শতভাগ নিশ্চিত হয়েই খাতা মূল্যায়ন করা হয়েছে বলে অনেক অভিভাবক অভিযোগ করেন। ফলে সচ্ছতার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ।
মো. আক্কাস উদ্দিন, আব্দুস সালাম, রুবেল খন্দকার সহ নাম প্রকাশ না করা শর্তে কয়েকজন অভিভাবক জানান, যারা প্রধান শিক্ষকের পদত্যাগের দাবী করেছিল তাদের অকৃতকার্য করতেই পরিচিতি সম্বলিত খাতা মূল্যায়ন করা হয়েছে।
এবিষয়ে বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের প্রতিনিধি মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগের বিষয়ে আমার জানা নেই। তিনি ভালো মানুষ তার বিরুদ্ধে একটি মহল ষড়যন্ত্র করছেন।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ শফি উদ্দিন বলেন, বিন্দু পরিমান অনিয়ম দুর্নীতি হয়নি। যা করা হয়েছে রেজুলেশন করে করা হহয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইউএনও দিলরুবা ইসলাম বলেন, আমার কাছে কোন অভিযোগ জমা পড়েনি। পেলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নিবো।