
আরিফ আহমেদ
বিশেষ প্রতিবেদক।।
ভারতে রপ্তানী বন্ধ হওয়ার পরও ইলিশ এখনো দরিদ্র মানুষের নাগালের বাইরে। তবে ঝাটকা পাওয়া যাচ্ছে ৫০০-৪৫০ টাকা দরে। সংবাদ মাধ্যমের প্রচারণার কারণে গত দু’দিন ধরে কিছু ইলিশ বাজারে এলেও তার আকার খুবই ছোট। দু-চারটে বড় বা কেজি ওজনের ইলিশ এলেও সেগুলোর দাম চড়া জানালেন ক্রেতারা। ক্রেতাদের দাবি- বরিশালের বাজারে ইলিশের আকার আকৃতি বলে দিচ্ছে এগুলো বাছাইকৃত ফেলে দেয়া মাছ। যা এলসি হয়না কখনো। আর জেলেদের দাবি- ডিজেল খরচ বাচাঁতে তারা এখন আর গভীর সমুদ্রে যান না। মাছ যা পান তা পর্যাপ্ত নয়। কেউ কেউ অবশ্য বললেন- দেশের চাহিদা অনুযায়ী মাছের সংকট থাকলেও এখনো কোনো না কোনোভাবে ভারতে যাচ্ছে বাংলাদেশের ইলিশ। তা না হলে উত্তরাঞ্চলে এতো মাছ কেন যাচ্ছে ক্রেতাদের দাবী- গতকালও ভারত থেকে ডিম এসেছে বাংলাদেশে। তাই বিনিময়ে ইলিশ দিচ্ছে না তার কি নিশ্চয়তা আছে-
যদিও মাছ ব্যবসায়ী ও আড়ৎদারদের দাবী- সরাসরি কোনো ইলিশ ভারতে যাচ্ছে না এখন আর। পরিবেশগত কারণে সাগর ও নদীতে ইলিশ কম ধরা পরছে বলে জানালেন ব্যবসায়ীরা। তবে আড়ৎদার ও মৎস্য ব্যবসায়ীরা স্বীকার করেন- তাদের সবচেয়ে বড় ক্রেতা বগুড়া ও রাজশাহী অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা। এদিকে আমাদের উত্তরাঞ্চল প্রতিনিধি জানালেন- সেখানের বাজারেও ইলিশ নেই। যা আছে দাম খুব চড়া।
সবমিলিয়ে ইলিশ নিয়ে বাজারে ও চা আড্ডায় আলোচনার ঝর বইছে দেশের আনাচকানাচে। সাধারণ মানুষের পাতে ইলিশ পরেনি গত ১৫টি বছর। ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে পাওয়া নতুন বাংলাদেশেও কি জাতীয় মাছ ইলিশ বঞ্চিত থাকবে নিম্ন আয়ের মানুষেরা- এসময় ভারত থেকে ডিম আমদানি নিয়ে নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন অনেকেই। বলেন, ডিম যখন আসছে- ইলিশও তখন যাচ্ছে দাবী সাধারণ মানুষের।
সরেজমিনে ১০ সেপ্টেম্বর সকাল থেকে বরিশালের ইলিশ মোকাম খ্যাত পোর্ট রোড বাজার ঘুরে দেখা গেছে-আগের তুলনায় বেড়েছে ইলিশের আমদানি। তবে বেশিরভাগ মাছের আকৃতি ছোট এবং ঝাটকার পরিমাণ বেশি। ২৫০-৩০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছিল ৬০০ টাকা কেজি দরে। আবার ঝাটকা আকৃতির ইলিশ বিক্রি হচ্ছিল ৪০০-৫০০ টাকা দরে। তিন-চারটি ডালায় কেজি ওজনের বড় ইলিশ দেখা গেল। এখানে আবার দরে তারতম্য। ১২০০ টাকা থেকে ১৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কয়েকজন ক্রেতা বললেন-বাজারে যে ইলিশ দেখছেন- এগুলো বেশিরভাগই বাছাই করে ফেলে দেয়া মাছ। এসব ছোট মাছ এলসি হয়না। তারমানে দাড়াচ্ছে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ছে সাগরে। ব্যবসায়ীরা এলসি করার পর যা থেকে যাচ্ছে সেটাই এখন বাজারে এসেছে।
আর বিক্রেতারা বলছেন- গতকাল আজকের তুলনায় ২০০ টাকা কম ছিলো- আজ আবার বেড়েছে দাম।
কেন বাড়লো আজ-উত্তরে বললেন- আজ মাছের আমদানি কম- চাহিদা বেশি বলে বেড়েছে। আমদানি কম কেন হলো আবার?
এ প্রশ্নের উত্তর আড়ৎদার ও জেলেরা জানে বলে হেসে দিলেন বিক্রেতা আনিস। ক্রেতারা তখনও ভিড় করে আছেন বিভিন্ন মাছের ডালির সামনে। সবমিলিয়ে পোর্ট রোড ইলিশ পাড়ায় ১৫-২০টি ডালিতে মোটামুটি ইলিশ দেখা গেল।
এখানের সবচেয়ে বড় মোকাম বা আড়ৎদার আল আমিন ফিস। ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর- জহির উদ্দিন ও অঞ্জন দাস সহ কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা গেল, বরিশালের মোকামে আগে হাজার টন ইলিশ আসতো। পদ্মা ও পায়রা সেতু হওয়ার পর থেকেই তা কমে গেছে। বর্তমানে পোর্ট রোড ইলিশ পাড়ায় সর্বোচ্চ ১০০ টন ইলিশ আসে। আর আজ মঙ্গলবার সকালে এলসি হয়েছে ৬০ টন মাত্র।
তাদের সবচেয়ে বড় পাইকারী ক্রেতা বগুড়া ও রাজশাহী জোনের ব্যবসায়ীরা বলে জানালেন তারা। জাহাঙ্গীর বলেন- আজ সকালে বরিশালের মোকাম থেকে কেজি ওজনের যে ইলিশ বিক্রি হয়েছে তার দাম পাইকারী ১৫৫০ টাকা ছিলো। ১২০০ গ্রাম মাছটি বিক্রি হয়েছে ১৬৫০ টাকা দরে। ৫০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হয়েছে ১২০০টাকা এবং ২৫০ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হয়েছে ৬০০ টাকা দরে।
ব্যবসায়ীরা আরো বলেন- ডিজেলের দাম আরো কমাতে হবে, তানা হলে মাছের দাম কমবেনা বলে জানান তিনি।
এ-সময় তাদের সামনেই বরগুনা ও পটুয়াখালীর দুটি মোকামে কথা বলে জানা গেল- তাদের মাছও ট্রাক বোঝাই হয়ে বগুড়া ও রাজশাহী অঞ্চলের মাছ ব্যবসায়ীরা নিয়ে গেছে। তারাও বিক্রি করেছেন একই দরে।
বরিশালের শায়েস্তাবাদ এলাকায় কয়েক ঘর জেলে পরিবার রয়েছে। তাদের একজন রুহুল আমিন বসেছিলেন পোর্ট রোডের মোবারকের আড়তে। রুহুল আমিন জানালেন, নদীতে তীব্র স্রোত চলছে। উপর থেকে বোঝা যায়না। তাই এই সিজনে নদীতে আর ইলিশ পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।
তিনি আরো বলেন- আমাদের জেলেদের অবস্থা খুবই খারাপ। নদীতে মাছ না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা সবাই।
জেলেদের নেতা খোরশেদুল মুন্সি জানান- নদীতে কোনো ইলিশ নেই। প্রাকৃতিক দূর্যোগের কারণে ডিমও ছাড়তে পারেনি এবার। তাছাড়া আমাদের যখন নিষেধাজ্ঞা চলে, ভারতের তখন ভরা মৌসুম। সাগরে কিছু মাছ এখন ধরা পরছে। তবে তা সাগর পাড়েই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে বলে জানান তিনি।
সাগর পাড় থেকে বগুনার আল্লাহর দান আড়ৎদার মোজাহিদ জানালেন- সাগরে মোটামুটি ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের মোকামগুলো থেকে সকালে প্রায় ৫০০ টন ইলিশ বগুড়া ও রাজশাহী অঞ্চলে গেছে।
এদিকে উত্তরাঞ্চলের বগুড়া ও রাজশাহীতে পরিচিতজন ও সাংবাদিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বরিশালের বাজারের সাথে খুব একটা পার্থক্য নেই ওখানকার বাজারে। ইলিশের দাম এখানেও খুবই চড়া।
বগুড়া থেকে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বগুড়া থিয়েটার অন্যতম সদস্য রুবল লোদী জানালেন- বগুড়ার বাজারেও ইলিশের দর চড়া। ৩০০-৪০০ গ্রামের ইলিশ ৬৫০-৭০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। মাঝারি সাইজের ইলিশ পনেরশো টাকার নিচে নেই।
সাধারণ ক্রেতাদের মনে তাই নানান প্রশ্ন। দক্ষিণাঞ্চলের ইলিশ উত্তরাঞ্চলে কেন যায়-সেখানের বাজারেতো ইলিশ নেই। তাহলে মাছগুলো যায় কোথায়?