মাসের প্রচেষ্টা নেমে এসেছে সেকেন্ড-মিনিটে। কয়েক মাসের কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে বিতরণ করা হতো যে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ভাতা সেটি বিতরণ করতে এখন লাগছে মাত্র কয়েক মিনিট। সাড়ে ৮৮ লাখ ভাতাভোগীর ডাটাবেজ তৈরি, এখন কেবল কয়েকটা বাটনে চাপলেই হয়ে গেল। নিমিষেই পৌঁছে যাবে হাজার কোটি টাকার ভাতা। বিদেশ নয়, বরং বাংলাদেশেই সমাজসেবা অধিদফতরের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ভাতা বিতরণ এমনই ডিজিটাল প্রক্রিয়ায় চলে এসেছে, যেখানে পলকেই হয়ে যাচ্ছে আগের বহু প্রচেষ্টার কাজ।
চমক জাগানো এই তথ্যের পর যখন কেউ জানবে যে, অন্যান্য সরকারি প্রকল্পে যেমন দফায় দফায় মেয়াদ বাড়ানো হয় এখানে কিন্তু ঘটেছে উল্টো ঘটনা। পাঁচ বছর মেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে মাত্র তিন বছরের মধ্যে বাস্তবায়ন করে ফেলেছে সমাজসেবা অধিদফতর। এই প্রক্রিয়ায় ৪৯ লাখ বয়স্ক ব্যক্তি, ২০ লাখ ৫০ হাজার জন বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা, ১৮ লাখ অসচ্ছল প্রতিবন্ধী এবং এক লাখ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদেরকে সমাজ সেবা অধিদফতর ভাতা দিচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খান খসরু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, পাঁচ বছর মেয়াদী লক্ষ্য নিয়ে কাজ শুরু হলেও মাত্র তিন বছরের মধ্যে ডিজিটালাইজেশনের কাজ করে ফেলেছে সমাজসেবা অধিদফতর। এর ফলে অনলাইন ব্যাংকিং ও মোবাইল ব্যাংকিং এর সেবা দেওয়া সহজ হবে। ডিজিটালাইজেশনের কাজ করতে গিয়ে আমাদের মাঠ কর্মীদের ওপর কিছুটা চাপ সৃষ্টি হলেও অনলাইন ব্যাংকিংয়ের কাজ সহজ হয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে জানি তারা কী পরিমাণ পরিশ্রম করে ডিজিটালাইজেশনের এই প্রক্রিয়াটা সম্পন্ন করেছে। এর মাধ্যমে ডিজিটালাইজেশন আসলে তৃণমূল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, আশা করি সরকারের সকল মন্ত্রণালয় এবং দফতর এরপর একে একে এভাবে ডিজিটাল প্রক্রিয়া গ্রহণের মাধ্যমে নিজেদের সেবার পরিসর আরও বিস্তৃত করতে পারবে। যাতে জনগণের ঘরের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে যাবে।
প্রসঙ্গত, তিন বছর আগে ‘ক্যাশ ট্রান্সফার মর্ডানাইজেশন’ নামে একটি প্রকল্প নেয় সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সমাজ সেবা অধিদফতর। এই প্রকল্পের আওতায় সাড়ে ৮৮ লাখ সুবিধাভোগীকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীর ভাতা বিতরণ প্রক্রিয়াকে ২০২৩ সালের মধ্যেই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে তুলে আনার লক্ষ্য ঠিক করা হয়। কিন্তু ইতিমধ্যে ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়ার বড় কাজগুলোই সম্পন্ন হয়ে গেছে। চলতি জুনের মধ্যেই ভাতা বিতরণ প্রক্রিয়ার পুরোটাই ডিজিটাল প্লাটফর্মে চলে আসবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
সমাজসেবা অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সাড়ে ৮৮ লাখ সুবিধাভোগীর মধ্যে ইতোমধ্যে ৫০ লাখ অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে যার মাধ্যমে ইতিমধ্যে ভাতা বিতরণ শুরু হয়ে গেছে। প্রকল্পের বাকি কাজ আগামী দেড় মাসের মধ্যেই সম্পন্ন হয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন তারা। ফলে তখন আর ভাতা বিতরণের জন্যে মাসের পর মাস কাজ করতে হবে না।
মূলত দুটি মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস কোম্পানি এবং তিনটি ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে এই ভাতা বিতরণ করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে তিনটি ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বারো লাখ ১৩ হাজার সুবিধাভোগীকে ভাতা দেওয়া হচ্ছে।
আর বাকি ৭৬ লাখ ৩৭ হাজার জনের মধ্যে ৭৫ ভাগ ভাতা বিতরণ করছে ডাক বিভাগের মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস ‘নগদ’ এবং বাকি ২৫ শতাংশ বিকাশ। সেক্ষেত্রে ‘নগদ’ ৫৭ লাখ এবং বিকাশ ১৯ লাখ জনের ভাতা বিতরণ করছে।
চলতি অর্থ বছর সরকার এই চারটি কর্মসূচির আওতায় মোট পাঁচ হাজার ৮৮৫ কোটি ৬৪ লাখ টাকা বিতরণ করছে। কর্মসূচিগুলোর আওতায় বয়স্ক ভাতাভোগী ব্যক্তি এবং বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা ভাতাভোগীরা জনপ্রতি মাসে ৫’শ টাকা করে পাবেন। এই দুটি কর্মসূচীতে সরকারের বরাদ্দ রয়েছে দুই হাজার ৯৪০ কোটি এবং এক হাজার ২৩০ কোটি টাকা।
অসচ্ছল প্রতিবন্ধীরা জনপ্রতি মাসে সাড়ে সাতশ টাকা করে পাচ্ছেন। তাদের জন্যে মোট বরাদ্দ আছে এক হাজার ৬২০ কোটি টাকা। আর এক লাখ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য ৯৫ কোটি ৬৪ লাখ টাকা শিক্ষা উপবৃত্তি রয়েছে। শ্রেণিভেদে মাধ্যমিক থেকে স্নাতক পর্যন্ত একেকজন শিক্ষার্থী মাসে সাড়ে সাত’শ থেকে ১৩’শ টাকা পর্যন্ত সরকারি সহায়তা পাচ্ছেন। আর এই পুরো অর্থই বিতরণ করা হচ্ছে ডিজিটাল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় তাদের ক্যাশ ট্রানজেকশন মর্ডানাইজেশন প্রকল্পের আওতায় পরবর্তী পাঁচ বছরের মধ্যে তাদের সকল ভাতা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে বিতরণের সিদ্ধান্ত নেয়। সে অনুসারে ২০২৩ সালের মধ্যে এক্ষেত্রে ডিজিটালাইজেশন নিশ্চিত করার লক্ষ্য থাকলেও গত বছরের শুরুতে মুজিববর্ষ উপলক্ষে ২০২১ সালের মধ্যেই তারা প্রকল্পটি সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত নেয়। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ডিজিটাল প্রক্রিয়ায় ভাতা বিতরণের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।