
এম এইচ হৃদয় খান, গাজীপুর
শাহজাহান ফকির—একটি নাম, যা গাজীপুরের রাজনীতিতে বিতর্কের সৃষ্টি করেছে, কিন্তু যিনি কোনোভাবেই রাজনৈতিক দায়-দায়িত্বের সম্মুখীন হননি। বিএনপির শীর্ষ নেতাদের অক্ষমতার কারণে তার অপরাধের ছায়ায় দলের আদর্শ সঙ্কুচিত হতে হতে আজ এক শূন্যতার মধ্যে পতিত। মিথ্যা সনদ, দুর্নীতি, টেন্ডার বাণিজ্য এবং আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে আঁতাত—এসব কিছুই তাকে থামাতে পারেনি, কারণ তার আশ্রয়দাতা—দলীয় আত্মীয়তা। বিএনপির এই দুর্নীতি প্রবণ নেতা যদি আজও অটুট পদে থাকে, তবে সেটা দলের পক্ষে এক ভয়াবহ সংকেত।
২০২৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি, শাহজাহান ফকিরের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ ওঠে, যখন স্থানীয় বাসিন্দা মো. সেলিম ফকির অভিযোগ করেন, তিনি বরমী ডিগ্রি কলেজের এডহক কমিটির সভাপতির পদে থাকাকালীন সময়ে ভুয়া স্নাতক ডিগ্রির সনদ জমা দিয়েছেন। ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে প্রকাশিত চিঠিতে পুরো বিষয়টি নিশ্চিত করা হয় এবং শাহজাহান ফকিরের পদচ্যুতির নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে এই রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত, যা একটি গুরুতর অপরাধের স্বীকৃতি, বিএনপির শীর্ষ নেতাদের চোখে কোনো গুরুত্ব পায় না।
এটা শুধু সনদ জালিয়াতি নয়, বিএনপির রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতির মহোৎসব! ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে, শাহজাহান ফকির ৩.৩৮ কোটি টাকার সড়ক প্রকল্পের দুর্নীতির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠেন। বিন্দুবাড়ি-ইজ্জতপুর সড়কের নির্মাণ কাজের টেন্ডার নিজের হাতে তুলে নিয়ে, নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার এবং অস্বীকৃত কাজ চালিয়ে যান। প্রকল্পের কর্মকর্তা উপজেলা প্রকৌশলী তাকে কাজ বন্ধ করার নির্দেশ দিলেও, শাহজাহান ফকির রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে কাজ অব্যাহত রাখেন। বিএনপির নেতারা জানাচ্ছেন, ফকিরের বিরুদ্ধে আরও অনেক অবৈধ কর্মকাণ্ড এবং টেন্ডার বাণিজ্যের একের পর এক অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়া, ২০২৪ সালের ১১ আগস্ট, শাহজাহান ফকির গোপনে মাওনা ইউপি চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম খোকনের সঙ্গে বৈঠক করেন, যেখানে তিনি বিএনপি নেতাদের হয়রানি না করার বিনিময়ে ৬ লাখ টাকা গ্রহণ করেন। এর পরদিন, শাহজাহান ফকির আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান খোকনকে নিয়ে শ্রীপুর থানার একটি সরকারি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন—ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। দলীয় শীর্ষ নেতাদের কোনো কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া, এই অপরাধের পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ার এক দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়ায়।
এখন, সবচেয়ে ঘৃণিত ও অপ্রকাশিত সত্য হলো—শাহজাহান ফকিরকে রক্ষা করার একমাত্র কারণ তার আত্মীয়তা। শাহজাহান ফকিরের চাচাতো ভাই, ডা. শহিদুল্লাহ ফকির বিবাহ করেছেন বিএনপির ঢাকা বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক কাজী সাইয়েদুল আলমের বোনকে। এই আত্মীয়তার কারণে তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। গাজীপুর জেলা বিএনপির নেতারা যখন এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলছেন, তখন কেন্দ্রীয় নেতাদের নীরবতা আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠছে।
জেলা বিএনপির নেতারা বলছেন, “শাহজাহান ফকিরের মতো ভাইরাসকে রক্ষা করা মানে দলের ভেতরে দুর্বৃত্তায়ন ও অরাজকতার ছায়া তৈরি করা। যদি এখনই কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে বিএনপি গাজীপুর নয়, গোটা দেশের মধ্যে জনগণের আস্থা হারাবে।” এই মুহূর্তে গাজীপুর জেলা বিএনপির সামনে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন—আদর্শ রক্ষা না আত্মীয়তার প্রতি শ্রদ্ধা?
এ বিষয়ে জেলা আহ্বায়ক ফজলুল হক মিলন বলেন, “আমরা বিষয়টি জানি, সনদ জালিয়াতির প্রসঙ্গে তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে, তবে এখনও কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।”
অতএব, বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সামনে এখন একটি কঠিন সিদ্ধান্ত—আদর্শ রক্ষা করবেন, নাকি আত্মীয়তার বন্ধনে রাজনীতির নৈতিকতা বিসর্জন দেবেন? সময় এখনই আসছে, এবং ইতিহাস কখনো এমন এক ভয়ানক সিদ্ধান্তকে ক্ষমা করবে না।