পুঁজি কম থাকলে ডিলারশিপের ব্যবসা শুরু করা নিরাপদ ও লাভজনক। আজ আমরা আলোচনা করব ডিলারশিপের ব্যবসা কী, ডিলার হতে চাইলে কী কী করা প্রয়োজন, কিভাবে ডিলারশিপ নিতে হয়, ডিলারশিপ ব্যবসার নিয়ম। আমরা জেনে নেব কয়েকটি ডিলারশিপ বিজনেস আইডিয়া যা আপনি শুরু করতে পারবেন কম টাকায়।
ডিলারশিপ ব্যবসা কী: কোনও কোম্পানির ডিলারশিপ নেওয়ার অর্থ হল একটি নির্দিষ্ট এলাকায় সেই কোম্পানির পণ্যের বিপণন ও বন্টনের যাবতীয় দায়িত্ব নেওয়া। যেমন ধরুন পার্লে কোম্পানি আপনার এলাকায় ডিলার নিয়োগ করবে। আপনি যদি সেই ডিলারশিপ নিতে চান তাহলে চুক্তি অনুযায়ী আপনাকে সেই এলাকার পার্লে-এর যাবতীয় দায়িত্ব নিতে হবে। পণ্য বিপণন থেকে উপভোক্তাকে সুযোগ সুবিধা দেওয়া পুরোটাই দেওয়া হবে আপনার মাধ্যমে।
ডিলারশিপ ব্যবসার নিয়ম: ডিলারশিপ ব্যবসা করতে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির সঙ্গে একটি চুক্তিতে আবদ্ধ হতে হয়। অর্থাত্ একটি ডিলারশিপ চুক্তিপত্র সই করতে হয়। এই চুক্তিপত্রে ব্যবসার যাবতীয় শর্ত বিস্তারিতভাবে লেখা থাকে। প্রতিটি ডিলারশিপ ব্যবসার কিছু চাহিদা থাকে যা কোম্পানি থেকে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়।
এরমধ্যে মার্কেটিং টিম, কভার ভ্যান, মাল রাখার গুদাম ইত্যাদি নানা কিছু থাকতে পারে। প্রথমেই কোম্পানির প্রতিনিধিরা নিশ্চিত করবেন আপনার ব্যবসার জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো রয়েছে কি না। যদি তাঁরা মনে করেন সবকিছু যথাযথ সেক্ষেত্রে কোম্পানি আপনার সঙ্গে চুক্তিপত্র সই করবে। কোনও কোনও কোম্পানি ব্যাঙ্ক গ্যারান্টিও চাইতে পারে।
এর পর চুক্তি মোতাবেক কোম্পানি আপনাকে বাকিতে মাল পাঠাতে পারে, অথবা আপনাকে নগদ দিয়ে কিনতেও হতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোম্পানিরা বিক্রির ওপর কমিশন দিয়ে থাকে। কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির সময়ে শর্তগুলি ভাল করে পরিষ্কার করে বুঝে নেবেন যাতে ব্যবসা শুরু করার পর কোনও সমস্যায় না পড়তে হয়।
কিভাবে ডিলারশিপ নিতে হয়?: ডিলারশিপ ব্যবসা শুরু করতে হলে প্রথমেই নির্দিষ্ট কোম্পানি ও পণ্য চিহ্নিত করতে হবে। আপনি যে এলাকায় কাজ করবেন সেই এলাকায় সেই পণ্যে যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে কি না, ক্রেতারা সেই পণ্য কিনতে আগ্রহী হবে কি না। সেই কোম্পানি যে দামে জিনিস বিক্রি করছে তা আপনার এলাকার জন্য উপযুক্ত কি না তা মাথায় রাখতে হবে।
এর পর জানতে হবে আপনার এলাকায় সেই কোম্পানি ডিলার নিয়োগ করতে আগ্রহী কি না। অন্যথায় আপনি স্বতঃপ্রণোদিত হয়েও যোগাযোগ করতে পারেন। কোম্পানি রাজি হলে ডিলারশিপ চুক্তিপত্র সই করার মাধ্যমে শুরু করতে পারেন আপনার ডিলারশিপের ব্যবসা।
১৩ টি লাভজনক ডিলারশিপ বিজনেস আইডিয়া: ১. কৃষিকাজে প্রয়োজনীয় সার, কীটনাশক ইত্যাদির ডিলারশিপ: সার, কীটনাশক ইত্যাদির ডিলারশিপ একটি অত্যন্ত লাভজনক ব্যবসা হতে পারে। আপনার এলাকায় যদি এই সমস্ত পণ্যের চাহিদা থাকে তাহলে এই ব্যবসার কথা ভেবে দেখুন। অবশ্যই শহরাঞ্চলে এই ব্যবসার কোনও ভবিষ্যত্ নেই কিন্তু গ্রাম বা শহরতলির দিকে এই ব্যবসা থেকে উপার্জন সম্ভব।
২. কৃষির যন্ত্রাদির ডিলারশিপ: কৃষিকাজে যে সমস্ত যন্ত্র ব্যবহৃত হয় সেগুলি বিক্রি করেলও ভাল লাভ করতে পারবেন। ভারতে কৃষির যন্ত্রাদির প্রচুর চাহিদা রয়েছে। ছোট হাতে চালানো যন্ত্রের চাহিদা বেশ বেশি। এই ব্যবসা শুরু করতে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করুন।
৩. গাড়ির যন্ত্রাংশের ডিলারশিপ: গাড়ির ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে আর তার ফলে গাড়ির মেরামতি ও গাড়ির বিভিন্ন যন্ত্রাংশের চাহিদাও বাড়ছে। এছাড়াও গাড়ি ডেকরেশনের নানা উপাদানেরও ভাল চাহিদা রয়েছে। এই ব্যবসা একটি লাভজনক ডিলারশিপ বিজনেস আইডিয়া।
৪. প্রসাধনীর ডিলারশিপ: গ্রাম থেকে শহর, প্রসাধনী সামগ্রীর চাহিদা সর্বত্র। কোন ব্র্যান্ডের বা কোন পণ্যটির চাহিদা বেশি হবে তা সেই বিশেষ অঞ্চলের আর্থসামাজিক অবস্থার ওপর নির্ভরশীল। আপনি যদি উপযুক্ত কোম্পানির ডিলারশিপ নিতে পারেন তাহলে লাভ হবেই। পাশাপাশিই খুচরো ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলুন যাতে তাঁরা আপনার পণ্যটিকে বিক্রির জন্য বাড়তি চেষ্টা করেন।
৫. বিল্ডিং ও কনস্ট্রাকশন মেটেরিয়াল-এর ডিলারশিপ: আরও একটি লাভজনক ডিলারশিপ বিজনেস আইডিয়া হল বিল্ডিং ও কনস্ট্রাকশন মেটেরিয়ালের ব্যবসা। ইট, বালি, সিমেন্ট, লোহার চাহিদা কোনওদিনই ফুরোবে না। বিশেষত আপনি যদি এমন এলাকায় ব্যবসা করেন যেখানে নতুন নতুন বহুতল তৈরি হচ্ছে তাহলে ব্যবসা চলবে রমরম করে। এই ব্যবসার ডিলারশিপ নিলে প্রমোটার ও কন্ট্রাকটরদের সঙ্গেও ভাল সম্পর্ক রাখা বাঞ্ছনীয়, তাঁদের সূত্রেও ব্যবসা পেতে পারেন।
৬. বইয়ের ডিলারশিপ: বইয়ের ব্যবসা একটি লাভজনক ব্যবসা। বিভিন্ন বড় প্রকাশনী সংস্থার সঙ্গে চুক্তির ভিত্তিতে ডিলারশিপ নিতে পারেন। স্কুল কলেজের পাঠ্যবইয়ের ডিলারশিপ নিলে ভাল ব্যবসা হবে। কোন সংস্থার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হলে বেশি লাভ করা সম্ভব সে বিষয়ে সচেতন হয়ে সিদ্ধান্ত নিন। প্রাথমিক মার্কেট সার্ভে করে বাজার বুঝে নিতে পারেন। বইয়ের পাশাপাশি সিডি-ডিভিডি ও পত্র পত্রিকার ডিলারশিপও নিতে পারেন।
৭. এফএমসিজি-এর ডিলারশিপ: এফএমসিজি অর্থাত্ ফাস্ট মুভিং কনজিউমার গুড-এর ব্যবসা একটি অত্যন্ত লাভজনক ডিলারশিপ বিজনেস আইডিয়া। অগ্রণী প্রতিটি এফএমজিসি প্রস্তুতকারক সংস্থা তাদের পণ্যের বন্টনের জন্য বহু সংখ্যক ডিলার নিযোগ করে। যেহেতু এই সমস্ত পণ্য দৈনন্দিন ব্যবহার্য তাই এই ব্যবসাতে দ্রুত লাভ করা সম্ভব। শুধু পণ্য ও কোম্পানি নির্বাচনের ক্ষেত্রে যত্নবান হোন, এমন পণ্য বেছে নিন যা দ্রুত বিক্রি হওয়া সম্ভব ও যার বাজারে সুনাম রয়েছে।
৮. ওষুধের ডিলারশিপ: ওষুধ কোম্পানির ডিলারশিপও একটি লাভজনক ব্যবসা। ভারতে এটি একটি লোভনীয় ব্যবসা ক্ষেত্র। কোন কোম্পানির কোন ওষুধের ডিলারশিপ নেবেন তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এমন কোম্পানির সঙ্গে কাজ করুন যাদের বিপণন ও মার্কেটিং ভাল।
৯. চামড়ার পণ্যের ডিলারশিপ: চামড়ার পণ্য উত্পাদক সংস্থার থেকে ডিলারশিপ নিয়ে ব্যবসা করতে পারেন। এক্ষেত্রে এই ব্যবসার খুঁটিনাটি ভাল করে জানা প্রয়োজন। কোথা থেকে মাল নেবেন, সেই মালের সম্ভাব্য বাজার কোনটি ইত্যাদি সম্পর্কে ভাল করে জেনে নিন। যাচাই করুন বাজারমূল্য।
১০. আসবাবের ডিলারশিপ: বর্তমানে বিভিন্ন বড় আসবাব প্রস্তুতকারক কোম্পানি স্থানীয় ডিলারদের মাধ্যমে ব্যবসা করে থাকে। প্লাস্টিক, রট আয়রন, স্টিল, কাঠ ইত্যাদি নানা ধরনের আসবাবের ডিলারশিপ নিতে পারেন। কোন কোম্পানির আসবাবের ডিলারশিপ নেবেন বা কোন ধরনের আসবাবের ব্যবসা করবেন তা নির্ভর করছে আপনি কোন অংশের বাজার ধরতে চাইছেন তার ওপর।
১১. ভেষজ ও আয়ুর্বেদিক সামগ্রীর ডিলারশিপ: ভেষজ ও আয়ুর্বেদিক দ্রব্যের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পতঞ্জলি, ডাবরের মতো আয়ুর্বেদিক পণ্য প্রস্তুতকারকরা তাদের পণ্য ক্রেতার কাছে পৌঁছে দিতে বিভিন্ন এলাকায় বহু সংখ্যক ডিলার নিয়োগ করছে। এটি একটি লাভজনক ডিলারশিপ বিজনেস আইডিয়া।
১২. মিনারেল ওয়াটারের ডিলারশিপ: মিনারেল ওয়াটারের ব্যবসা মূলতঃ নির্ভর করে যে এলাকায় ব্যবসা করছেন সেই এলাকার জলের মানে ওপর। এছাড়াও বাসিন্দাদের আর্থসামাজিক অবস্থাও এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শহর ও শহরতলিতে প্রায় সর্বত্রই এখন মিনারেল ওয়াটারের চাহিদা রয়েছে। তবে ব্যবসা শুরুর আগে চাহিদা ও বর্তমান সরবরাহের বিষয়টিতে নিশ্চিত হয়ে নিন।
১৩. কাগজ ও স্টেশনারি দ্রব্যের ডিলারশিপ: কম খরচে ব্যবসা শুরু করতে হলে আরও একটি ডিলারশিপ বিজনেস আইডিয়া হল কাগজ ও স্টেশনারি দ্রব্যের ডিলারশিপ। এটি একটি বিরাট ক্ষেত্রে এবং নানা ধরনের পণ্য এর মধ্যে পড়ে। সবথেকে লাভজনক কয়েকটি পণ্য হল খাতা, পেন, পেন্সিল, রবার, আর্ট পেপার, প্রিন্টিং পেপার ইত্যাদি। এই ব্যবসা শুরু করতে খুব বেশি পুঁজির প্রয়োজন নেই।
উপরের এই ব্যবসাগুলো ছাড়াও আরও বিভিন্ন লাভজনক ডিলারশিপ বিজনেস আইডিয়া রয়েছে। আপনাকে শুধু আপনার এলাকা অনুযায়ী উপযুক্ত পণ্যটি বেছে নিতে হবে, তাহলেই সাফল্য পাওয়া সম্ভব। আপনার পুঁজির ওপরও নির্ভর করবে কোন পণ্যের ডিলারশিপ আপনি নিতে পারেন।
প্রথমবার শুরু করার জন্য কম পুঁজি দিয়ে শুরু করতে পারেন ও পরবর্তীতে ব্যবসা বাড়াতে পারেন। প্রয়োজনে ব্যবসা ঋণ নেওয়ার কথাও ভাবতে পারেন। বিজনেস ডিলারশিপ আইডিয়া নিয়ে আপনার আরও কিছু জানার থাকলে আমাদের জানান, প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে আমরা সাহায্য করব আপনাকে।