
মোঃ আবু কাওছার মিঠু, রূপগঞ্জ(নারায়ণগঞ্জ) প্রতিনিধি:
আজ শনিবার ১৩ ডিসেম্বর। রূপগঞ্জ মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে রাজধানী ঢাকার উপকন্ঠ রূপগঞ্জ হানাদার মুক্ত হয়। এ দিন মুক্তিযোদ্ধা ও এলাকাবাসীর তুমুল প্রতিরোধের মুখে পাকহানাদার বাহিনী এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর রূপগঞ্জ ছেড়ে পার্শ্ববর্তী কুমিল্লা জেলা ও ঢাকার অভিমুখে পালিয়ে যায়। ফলে হানাদার মুক্ত হয় রূপগঞ্জ।
মুক্তিযুদ্ধের ৩ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল কেএম সফিউল্লাহ (বীর-উত্তম) তাঁর `এস` ফোর্স ও মিত্রবাহিনী, তৎকালীন উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবদুল জব্বার খানের পিনু গ্রুপ ও গফুর কমান্ডার গ্রুপসহ প্রায় দুই হাজার মুক্তিযোদ্ধার বিশাল বাহিনী সেদিন বিজয় পতাকা উত্তোলন করে রূপগঞ্জকে শত্রুমুক্ত ঘোষণা করে। মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের তিনদিন আগে ১৩ ডিসেম্বর হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে মিত্রবাহিনী।
আগের দিন রাতে কুমিল্লার দিক থেকে আসা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে পরদিন দুপুর পর্যন্ত সম্মুখযুদ্ধে হানাদার বাহিনী কোণঠাসা হওয়ার পর আত্মসমপর্ণের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৭১ সালের এই দিনে রূপগঞ্জকে আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তাঞ্চল ঘোষণা করা হয়। ১৩ ডিসেম্বর ৩নং সেক্টর কমান্ডার রূপগঞ্জের কিংবদন্তি মেজর শফিউল্লাহ তাঁর ‘এস’ ফোর্স ও মিত্রবাহিনী নিয়ে রূপগঞ্জের মাটিতে পা রাখেন।
মুক্তিযুদ্ধকালীন কমান্ডার আব্দুল জব্বার খান পিনু তার বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে শফিউল্লাহর সঙ্গে উপজেলার বর্তমান মুড়পাড়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ছাদে বিজয়ের পতাকা তুলে রূপগঞ্জকে শত্রুমুক্ত ঘোষণা করেন। তারপর ডেমরায় পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পের সদস্যরা সফিউল্লাহর কাছে অস্ত্র সমর্পণের পর ১৬ ডিসেম্বর শফিউল্লাহ ঢাকায় আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে যোগ দেন। ৯ মাসের এই যুদ্ধে রূপগঞ্জে ১১ বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। যাদের নামের তালিকাসহ রূপগঞ্জ উপজেলা চত্বরে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে।
১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে রূপগঞ্জবাসীর অবিস্মরণীয় অবদান বাঙালি জাতির স্বাধীনতার ইতিহাসে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। রূপগঞ্জের কৃতি সন্তান ও তৎকালীন সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান তার বাহিনীসহ ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে এসে এই তরুণ যুবক ও আনসারদের নিয়ে তৈরি করেন প্রতিরোধ বাহিনী। কয়েকদিন রূপগঞ্জে অবস্থান করে তরুণদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে তিনি তার বাহিনীসহ রূপগঞ্জের উত্তর-পূর্ব সীমানা থেকে কিছু দূরে নরসিংদী-ঢাকা সড়কের পাঁচদোনায় নরসিংদীগামী পাকবাহিনীর সেনা কনভয়ে প্রথম সফল আক্রমণ করেন। সেই হানাদার কনভয়কে সম্পূর্ণরূপে পরাস্ত করে তাদের প্রচুর অস্ত্র ও রসদ হস্তগত করে তিনি তার বাহিনী নিয়ে ভৈরব দিয়ে ভারতের দিকে অগ্রসর হন। রূপগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধের সূচনা এখানেই।
৭১ এর মে মাস থেকে রূপগঞ্জ হয়ে ওঠে মুক্তিযোদ্ধাদের অভয়ারণ্য। ঢাকা সিটির কয়েকটি গ্রুপসহ প্রায় ৫০টি গ্রুপের সহস্রাধিক মুক্তিযোদ্ধা রূপগঞ্জে অবস্থান নেয়। ঢাকার খসরু গ্রুপ, মায়া গ্রুপ, জিন্নাহ গ্রুপ, আউয়াল গ্রুপ, গফুর কমান্ডার গ্রুপ, নরসিংদীর মামা সিরাজ গ্রুপসহ স্থানীয় তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রায় ৫০টি গ্রুপ রূপগঞ্জে অবস্থান নেয়।
রূপগঞ্জের ভোলাব, ধামছির শালবন, ইউসুফগঞ্জ, কামশাইর, মাঝিনা, জাঙ্গীর, রূপগঞ্জ, পিতলগঞ্জ, শিমুলিয়া, গোলকান্দাইল, হোড়গাও হয়ে যায় মুক্তিযোদ্ধাদের অভয়ারণ্য। ঢাকা-নরসিংদী সড়কের আউখাব এলাকায় কাতরার পুলে আক্রমণ, মুড়াপাড়াস্থ গাউছিয়া জুট মিলের সেনা ক্যাম্পে মর্টার হামলা, শীতলক্ষ্যার জাঙ্গীরের চরে বাঙ্কারে অ্যাম্বুস করে হানাদার বাহিনীর রসদবাহী লঞ্চ ও গান বোটে আক্রমণ, পূর্বাইল স্টেশনের পাশে রেললাইন উপরে ফেলাসহ ইউসুফগঞ্জে হানাদার বাহিনীর অতর্কিত দ্বিমুখী আক্রমণকে প্রতিহত করে পাল্টা আক্রমণের মাধ্যমে তাদের পশ্চাৎগমনে বাধ্য করাসহ রূপসী নদীর ধারে ও বড়ালুর চরে বাঙ্কার করে নৌপথে যাতায়াতকারী হানাদার বাহিনীর নৌযানে আক্রমণগুলো ছিল রূপগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধের উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর রূপগঞ্জ হানাদার মুক্ত হয়।

























