
ইসমাইল ইমন চট্টগ্রাম জেলা প্রতিনিধি:
প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে নারীর অংশগ্রহণ এবং ভূমিকা ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হচ্ছে। আগে যেখানে কিছু নির্দিষ্ট পদে নারীদের দেখা যেত, এখন সচিব, ডিসি, ইউএনও সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীরা দায়িত্ব পালন করছেন। এই পরিবর্তন নারীদের ক্ষমতায়ন এবং সমাজে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে সাহায্য করছে।
প্রশাসনের কর্মক্ষেত্রে এখন নারীরা প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে আসছেন। বিভিন্ন স্তরে নারীর ক্ষমতায়ন এবং অধিকার সুসংহত করার জন্য আইন ও বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে, যা নারীদের কর্মজীবনে প্রবেশ ও অগ্রগতিতে সহায়তা করছে। সমাজে নারীর প্রতি প্রচলিত কিছু নেতিবাচক ধারণা ধীরে ধীরে পরিবর্তন হচ্ছে। নারীরা এখন যেকোনো পদে নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ দিচ্ছেন এবং যেকোনো বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখেন। কর্মক্ষেত্রে পুরুষ সহকর্মীরাও নারীদের সহযোগিতা করছেন এবং তাদের কাজের স্বীকৃতি দিচ্ছেন।
এই পরিবর্তন একটি ইতিবাচক দিক এবং আশা করা যায়, ভবিষ্যতে প্রশাসনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ আরও বাড়বে। প্রশাসনের সর্বস্তরে নারী কর্মকর্তাদের অবস্থান অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন সুদৃঢ়। জ্যেষ্ঠ সচিব থেকে সহকারী কমিশনার পর্যন্ত প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে তাঁদের সুদক্ষ নেতৃত্ব রয়েছে।
এসব নারী কর্মকর্তা পুরুষ কর্মকর্তাদের মতো নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। আগামী দিনে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে তাঁদের আরো উজ্জ্বল উপস্থিতির জানান দিচ্ছেন নবীন ক্যাডার কর্মকর্তারা
দীর্ঘদিন প্রশাসনের উচ্চ পদে নারীর সংখ্যা ছিল একেবারেই কম। যাঁরা সচিবের মতো বড় পদে পদোন্নতি পেতেন, তাঁদেরও দায়িত্ব দেওয়া হতো তুলনামূলকভাবে কম গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত মন্ত্রণালয় বা দপ্তরে। এখন সেই অবস্থার পরিবর্তন এসেছে।
প্রথমেই একজন নারীকে প্রমাণ করতে হয়, তিনি এ পদের যোগ্য কি না। তবে ধীরে ধীরে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন হচ্ছে। মানুষ ইতিবাচকভাবে নিচ্ছে। ভবিষ্যতে হয়তো আরো পরিবর্তন হবে।
প্রশাসনে নারী তার যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারীরা পুরুষ কর্মকর্তার চেয়ে বেশি দায়িত্বশীল, কাজে আন্তরিক ও সৎ।
‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ এ বাণী আজও নারীর ক্ষমতায়নের প্রেরণা হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশে নারীরা এখন শুধু ঘরের গ-িতেই সীমাবদ্ধ নেই, তারা দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন।
সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী থেকে শুরু করে পুলিশ, প্রশাসন, বিচার বিভাগ, শিক্ষা, চিকিৎসা, ব্যাংকিং, প্রকৌশলসহ সব ক্ষেত্রেই নারীরা দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছেন। প্রশাসনে সচিব থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীরা কাজ করছেন। তবে প্রশ্ন হলো সব সেক্টরে নারীরা কি সমানভাবে সফল হচ্ছেন? অবশ্যই। চট্টগ্রামের নতুন ডিসি ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে যোগদান করেছেন ফরিদা খানম। তিনিই এ জেলার প্রথম নারী ডিসি।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিভিন্ন বিভাগ ও দপ্তরের সংস্কার শুরু করেছেন। এরই অংশ হিসেবে গত ২০ আগস্ট চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলার জেলা প্রশাসককে (ডিসি) প্রত্যহার করে নিয়েছিল। অবশেষে ২৩ দিন পর নতুন জেলা প্রশাসক পেয়েছে চট্টগ্রামসহ অন্যান্য জেলা।
বিগত ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪(সোমবার )সালে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মাঠ প্রশাসন-২ শাখার উপসচিব হোসনা আফরোজ সই করা এক প্রজ্ঞাপনে ফরিদা খানমকে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।
জানা গছে, নতুন জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ফরিদা খানম ২৫তম বিসিএস (প্রশাসন) একজন কর্মকর্তা। তিনি গত ২০০৬ সালে সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে প্রথম যোগদান করে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর রংপুর ও নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সহকারী কমিশনার, নরসিংদী জেলার পলাশ উপজেলা, সদর উপজেলা ও শরীয়তপুর সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেন ফরিদা খানম। এর পর টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সিনিয়র সহকারী কমিশনার, ফেনী জেলার দাগনভূঞাঁ উপজেলা ও নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বিসিএস এই কর্মকর্তা।
এছাড়া মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরে প্রেষণে উপপরিচালক (ম্যাজিস্ট্রেট), বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনে উপপ্রধান, ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরে উপপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ফরিদা খানম। চট্টগ্রাম জেলায় জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগদানের পূর্বে তিনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে উপসচিব হিসেবে সংযুক্ত ছিলেন। শিক্ষাজীবনে তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর।
চট্টগ্রামের প্রশাসনিক ইতিহাসে প্রথমবারের মতো জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদে দায়িত্ব পেলেন একজন নারী। ১৭৭২ সালে চট্টগ্রাম জেলা কালেক্টরেট অফিস প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৯০ জন জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব পালনের মধ্যে কোনো নারী ছিলেন না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে এই প্রথম জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পান ফরিদা খানম।
বিগত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর(২০২৪) যোগদানের পর থেকেই বাজার মনিটরিং, প্রশাসনিক উন্নয়ন, শিক্ষা, পর্যটন ও জনস্বাস্থ্য সবক্ষেত্রে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা প্রশংসা কুড়িয়েছে। বিশেষ করে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে জেলা প্রশাসন সেলস সেন্টার ও কৃষকের হাট চালু, সরকারি সম্পত্তি উদ্ধার, খাল দখলমুক্ত করা ও গণশুনানির মাধ্যমে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত সমস্যার সমাধান তাঁকে জনআস্থার প্রতীক করে তুলেছে।
ফরিদা খানমের নেতৃত্বে গত তিন মাসে শত কোটি টাকার সরকারি সম্পত্তি উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধার হয়েছে ঐতিহ্যবাহী কালিরছড়া খালও। একই সঙ্গে পরিবেশ সুরক্ষা ও জনস্বাস্থ্য উন্নয়নেও তিনি রেখেছেন সরব ভূমিকা।
দায়িত্ব নেওয়ার পর দুর্নীতিমুক্ত, বৈষম্যহীন, গতিশীল ও জনবান্ধব প্রশাসন গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দেন ফরিদা খানম। ‘বাবা সবসময় বলতেন সততার সঙ্গে যোগ্য হতে হবে’ নিজের কর্মদর্শন ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এভাবেই স্মৃতিচারণ করেন কলেজশিক্ষক বাবার কথা।
যোগদানের দুই দিন পরই তিনি ছুটে যান শহীদ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মোহাম্মদ ওমর বিন আবছারের বোয়ালখালীর বাড়িতে। সেখানে শহীদের কবর জিয়ারত করে পরিবারকে শান্তনা দেন এবং তাৎক্ষণিকভাবে কবরস্থানের রাস্তা সংস্কার ও শহীদের নামে সড়ক নামকরণের ব্যবস্থা করেন।
প্রশাসনিক বদলিতেও তিনি এনেছেন স্বচ্ছতা ও নজির রেখেছেন। গত ১২ ডিসেম্বর জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে উন্মুক্ত লটারির মাধ্যমে ২৫ জন ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা ও ৭৮ জন ইউনিয়ন ভূমি উপসহকারী কর্মকর্তার পদায়ন করা হয়য়া প্রশাসনে এক বিরল দৃষ্টান্ত।
রমজানের আগে ২০ দিনের বাজার অভিযান চালিয়ে ১৬৮টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হয়, জরিমানা করা হয় ৪৬০টি প্রতিষ্ঠানকে। এতে বাজারের সিন্ডিকেট ভেঙে পড়ে, দ্রব্যমূল্যও স্বাভাবিক হতে শুরু করে।
পর্যটন খাতে তাঁর উদ্যোগও সমান আলোচনায়। ফৌজদার হাটে বঙ্গোপসাগরের তীরে জেলা প্রশাসনের ডিসি পার্কে গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে আয়োজিত ফুল উৎসবে ১৩৬ প্রজাতির লক্ষাধিক ফুলে মুখরিত ছিল পুরো এলাকা। পর্যটন উন্নয়নে চট্টগ্রাম বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির মাধ্যমে সমুদ্রসৈকত ব্যবস্থাপনায় নেওয়া হয়েছে মহাপরিকল্পনা।
গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম নেওয়া ফরিদা খানম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বিএসএস (সম্মান) ও এমএসএস ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০২৪ সালের আগস্টে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগ দেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি একজন পুত্রসন্তানের মা। তার স্বামী জহুরুল ইসলাম একজন সফল ব্যবসায়ী এবং তার বাবা ছিলেন একজন সম্মানিত শিক্ষক।
চট্টগ্রামের সংস্কৃতি এবং কৃষ্টিকে তুলে ধরে তিনি বলেন, “চট্টগ্রামের মানুষের হৃদয় অনেক বড়। সবাই যদি একত্রে কাজ করি, তবে চট্টগ্রামকে আধুনিক নগরীতে পরিণত করা সম্ভব।”
এই ঐতিহাসিক নিয়োগ চট্টগ্রামের জন্য যেমন একটি গর্বের বিষয়, তেমনি ফরিদা খানমের নেতৃত্ব প্রশাসনে নারীর অবদানের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
মাঠে কাজ করতে গিয়ে বেশিরভাগ মানুষের কাছ থেকে সম্মান পেয়েছি। এজন্য অনেক কাজের চাপ থাকলেও দায়িত্ব উপভোগ করেছি। তবে স্থানীয় স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর জন্য উন্নয়নমূলক কাজগুলো সাধারণ মানুষের স্বার্থে করতে গেলে বেগ পোহাতে হয়েছে।
ফ্যাসিষ্ট সরকারের বিদায়ের পর চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব থেকেও ফ্যাসিষ্ট সরকারের অনুসারীদের বিদায় করে নতুন কমিটি গঠিত হয়। স্বৈরাচারের দোসররা যাতে মানুষের ভরসাস্থল এই প্রেসক্লাবকে ফ্যাসিবাদের প্লাটফর্ম হিসেবে পুনরায় ব্যবহার করতে না পারে সে ব্যাপারে তিনি ভাল ভূমিকা রেখেছেন। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে স্বৈরাচার সরকারের পতন পরবর্তী সময় থেকে ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবকে ফ্যাসিবাদ মুক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা রাখা হয়। বর্তমান এই অন্তর্বর্তী কমিটির আহবায়ক চট্টগ্রাম ডিসি ফরিদা খানম। এই অন্তর্বর্তী কমিটির সদস্য সচিব দৈনিক আমার দেশ এর আবাসিক সম্পাদক জাহিদুল করিম কচি। অতীতে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবকে স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের মুখপাত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ফ্যাসিবাদ মুক্ত হওয়ায় এখন দল-মত নির্বিশেষে সবার জন্য প্রেস ক্লাব উন্মুক্ত।
আওয়ামী লীগের চরম দলীয় প্রশাসনকে পাল্টে দিতে খড়্গহস্ত ছিল এ সরকার। অধিকাংশ শীর্ষ কর্মকর্তাকে ওএসডি কিংবা বাধ্যতামূলক অবসরে যেতে হয়েছে। যদিও নারী সচিবদের বেশিরভাগ এখনো দায়িত্ব পালন করছেন, যা প্রশাসনে নারীদের অনন্য ভূমিকার দৃষ্টান্ত মনে করছেন প্রশাসন সংশ্লিষ্টরা। সম্প্রতি প্রশাসনে নারীদের উপস্থিতি প্রশংসার যোগ্য। প্রশাসনের বাইরেও নারীরা তাদের যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখছে। এটি অব্যাহত রেখে নারীকে আরও এগিয়ে যেতে হবে। চট্টগ্রামের এই নারী ডিসি চট্টগ্রামকে একটি মডেল জেলায় পরিণত করতে দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। সেই কারণে তাঁর প্রতি সাধারণ মানুষের আন্তরিকতা, ভালবাসা অবারিত।