
মোঃ আবু তৈয়ব,
হাটহাজারী পৌরসভার ১নং ওয়ার্ড এটিআই রোড ও শীলছড়ি রোড এবং ৯নং ওয়ার্ড মোহাম্মদপুর ও কমিউনিটি ক্লিনিক রোডে সড়কবাতি প্রকল্পের প্রায় ৫ কোটি টাকার কাজ সর্বোচ্চ দরদাতাকে দেওয়া হচ্ছে। দরপত্র মূল্যায়নে অনিয়ম ও সরকারি ক্রয় নীতিমালা লঙ্ঘন করে পৌরসভার কর্তৃপক্ষ ওই ঠিকাদারকে এই কাজ দিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ওই দরপত্রে অংশ নেওয়া অন্য ঠিকাদারেরা।
এর আগে কয়েকটি পত্রিকায় পৌরসভার প্রকৌশলী বেলালের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ এবং বেলালের কমিশন বানিজ্যের জন্য বিভিন্ন দপ্তরের প্রকাশিত সংবাদের কাটিংসহ অভিযোগ দেয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপসচিব মোহাম্মদ কবির উদ্দিনের স্বাক্ষরিত ৪৬.০০.০০০০.০০০.০৬৩.১৯.০০০২.২৫ (অংশ-১)-২২, গত ২৩ ফেব্রুয়ারী বদলি আদেশ জারি করেন। এতে উল্লেখ করা হয় যে, আগামী ৫ মার্চ পরবর্তী কর্মস্থলে যোগদানের কথা বলা হয়। তাতেও যদি যোগদান না করে তাহলে ৬ মার্চ থেকে স্ট্যান্ডরিলিজ হিসেবে গন্য হবে বলে জানানো হয়।
কাজ না পাওয়া ঠিকাদারেরা অভিযোগ করে বলেন, সরকারি ক্রয় নীতিমালা অনুযায়ী সর্বনিম্ন ও দ্বিতীয় নিম্ন দরদাতাকে কাজ না দিয়ে, সর্বোচ্চ দরদাতাকে সরবরাহের কাজ দেওয়া হয়েছে। এতে সরকার ও পৌরসভার কমপক্ষে কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। পৌর প্রকৌশলীর কমিশন সুবিধা গ্রহণ করে নিজেদের ইচ্ছেমতো সর্বোচ্চ দরদাতাকে সরবরাহের কাজ দিয়েছে। দরপত্র মূল্যায়নে সময়ক্ষেপণ করেছে।
তারা আরও জানান, একই ব্র্যান্ডের একই সড়কবাতি কেন ১ কোটি টাকা বেশি দিয়ে সর্বোচ্চ দরদাতার সাথে চুক্তি? যে মেসার্স ফিলামেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড এর নেই কোন অভিজ্ঞতা, নেই আরওএইচএস,সিই এবং টিইউভি সার্টিফিকেট। অথচ প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় যারা তাদের প্রত্যকের সব কিছুই ঠিক আছে। তাদের এক একজনের টার্নওভার কয়েকশ কোটি টাকা। তাদের কাজেই লাইটিং কিংবা সড়কবাতি এবং বড় বড় হাইমাস্ট টাওয়ার এবং সাবস্টেশন করার অভিজ্ঞতা থাকার স্বত্বেও নতুন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কে কাজ দেয়া মানে অর্ধ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে বলেই তার সাথে চুক্তি করেছেন। এমনকি বেলাল সর্বনিম্ন দরদাতার কাছে ৩০ লাখ টাকা চান। কিন্তু তিনি দিতে রাজি হননি বলেই যার কাছে থেকে টাকা পেয়েছে তাকে কাজ দিয়েছে বলে তারা অভিযোগ করেন। এই টাকার বেশি ভাগ অংশ পিডির কাছে যায় বলেই পিডি
হাটহাজারী পৌরসভার কার্যালয়, দরপত্র বিজ্ঞপ্তি পর্যালোচনা ও ঠিকাদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০২৪ সালের ২৪ নভেম্বর হাটহাজারী পৌরসভার ১নং ওয়ার্ড এটিআই রোড ও শীলছড়ি রোড এবং ৯নং ওয়ার্ড মোহাম্মদপুর ও কমিউনিটি ক্লিনিক রোডে সড়কবাতি প্রকল্পের প্রায় ৫ কোটি টাকার সরবরাহের দরপত্র বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। ওই দরপত্র আহ্বান করেন হাটহাজারী পৌরসভার প্রকৌশলী বেলাল আহমেদ খান।ই-জিপির (ইলেকট্রনিক গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট) মাধ্যমে আহ্বান করা দরপত্র বিক্রির শেষ তারিখ, দাখিল ও খোলার তারিখ ছিল গত ৩০ ডিসেম্বর।
ঠিকাদারেরা জানান, নিয়ম অনুযায়ী (ই-জিপি টেন্ডারে) মোট ৪টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করেছে। দরপত্রে অংশ নেওয়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে মেসার্স সানি করপোরেশন, মেসার্স শুভেচ্ছা ইঞ্জিনিয়ারিং, মেসার্স এ এন্ড জে ইন্টারন্যাশনাল, মেসার্স ফিলামেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড।
ঠিকাদারেরা জানান, ২৮ নভেম্বর দরপত্র ক্রয়, দাখিল ও খোলার শেষ তারিখ রাখলেও মূল্যায়নে দরপত্র কমিটি সময় নিয়েছে ৩২ দিন। অর্থাৎ গত ৩০ ডিসেম্বর কোন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ পেয়েছে তা জানানো হয় এবং দুই দিনের মধ্যে ওই প্রতিষ্ঠানকে (সর্বোচ্চ দরদাতা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান) কার্যাদেশ দেওয়া হয়।
সরকারি ক্রয় নীতিমালা অনুযায়ী, দরপত্রে সর্বনিম্ন দরদাতার কাজ পাওয়ার কথা। কিন্তু এখানে দেখা গেছে, ৪টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সর্বোচ্চ দরদাতা মেসার্স ফিলামেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড পেয়েছে।
ঠিকাদারদের অভিযোগ, দরপত্র কমিটি দরপত্র মূল্যায়নে অকৃতকার্য হওয়া দরদাতাদের জামানত ফেরত দেবে এবং কী কারণে তাদের অকৃতকার্য দেখানো হয়েছে, সেই কারণ ঠিকাদারদের জানাবে। এখানেও ক্রয় নীতিমালা উপেক্ষা করা হয়েছে। এখনো তাদের কাজ না পাওয়ার কারণ জানানো হয়নি।
দরপত্র প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়া মেসার্স এ এন্ড জে ইন্টারন্যাশনালের পরিচালক ইব্রাহিম পারভেজ জানান, আমরা দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশ রেলওয়ে, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, জেলা পরিষদ, এলজিইডি, পৌরসভার বিভিন্ন টেন্ডারের নিয়ম অনুযায়ী দরপত্রে অংশগ্রহণ করে সুনামের সঙ্গে মালামাল সরবরাহ ও কাজ সম্পাদন করে আসছি। এবারও ই-জিপি দরপত্র অংশ নিয়েছি এবং হাটহাজারী পৌরসভার কর্তৃপক্ষের চাহিদা অনুযায়ী কাগজপত্র অনলাইনে জমা দিয়েছেন। ই-জিপি দরপত্রের নীতিমালা (পাবলিক প্রকিউরমেন্ট)অনুযায়ী আমাদের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সর্বনিম্ন দরদাতা হয়। তারপরও পৌরসভা কর্তৃপক্ষ কেন কাজটি আমাদের কে দেয়নি তা বুঝতে পারছি না। তবে বেলাল আহমেদ খান এই প্রকল্পের পিডি জন্য ৩০ লাখ টাকা চেয়েছেন কিন্তু আমরা দেয়নি বলেই কাজটি ফিলামেন্ট কোম্পানি কাছ থেকে এই কাজ এবং আরেকটি আড়াই কোটি টাকার প্রকল্পসহ ৫০ লাখ টাকা নিয়েছেন। তাই তাদের কে কাজ দিয়েছেন।
মেসার্স শুভেচ্ছা ইঞ্জিনিয়ারিং পরিচালক আবু সুফিয়ান বলেন, দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দরদাতা ছিলাম আমরা। কিন্তু তারপরও কাজটি দেওয়া হয়নি। কী কারণে সর্বনিম্ন দরদাতাদের সরবরাহের কাজটি দেওয়া হয়নি, হাটহাজারী পৌরসভার প্রকৌশলী বেলাল আহমেদ খান তা–ও জানায়নি।
ঠিকাদারেরা জানান, কী কারণে অন্য ঠিকাদারদের বাদ দেওয়া হয়েছে, সেটি মৌখিক, চিঠিপত্র বা ই–মেইলে জানানো হয়নি। দরপত্র কমিটির কাছে বিষয়টি জানতে চাইলে তারাও কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি। দরপত্র কমিটি ইচ্ছাকৃতভাবে অবৈধ সুযোগ নিয়ে সর্বোচ্চ দরদাতাকে কাজ দিয়েছে।
হাটহাজারী পৌরসভার একাধিক ঠিকাদাররা জানান, আমাদের পৌরসভার শুরু থেকে প্রকৌশলী বেলাল বদলি হওয়ার আগে পর্যন্ত কমিশন বানিজ্যের জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে অবৈধ সুযোগ নিয়ে সর্বোচ্চ দরদাতাকে কাজ দিয়েছে। এভাবেই আমাদের পৌরসভার ও সরকারের কোটি কোটি টাকা ক্ষতি করে নিজের পকেট ভরিয়েছেন। গড়েছেন কোটি কোটি টাকার জমি, ফ্ল্যাট, গাড়ি এবং বাড়ি।
কেন আপনার ঠিকাদারি কোম্পানি সর্বোচ্চ দরদাতা হওয়ার পরও বড় বড় ৩টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কে বাদ দিয়ে আপনাদের সাথে চুক্তি করেছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে মেসার্স ফিলামেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার সিয়াম জানান, টেন্ডারের শর্ত অনুযায়ী এবং অন্যান্য ঠিকাদারদের এই কাজের অভিজ্ঞতা নেই। আমাদের অভিজ্ঞতা আছে তাই টাকা বেশি দিয়ে পৌরসভার কর্তৃপক্ষ চুক্তি করেছেন। এরপর আপনার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কি এই কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে জন্ম গ্রহণ করেছেন কি? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, অভিজ্ঞতা নিয়ে কেউ জন্মায় না। তবে কাজ করতে করতে অভিজ্ঞতা হয়। আমার মনে হচ্ছে এ বিষয়ে পৌরসভা এবং পিডি স্যার ভালো বলতে পারবেন।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে হাটহাজারী পৌরসভার প্রকৌশলী বেলাল আহমেদ খানকে বার বার ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি।
সর্বনিম্ন দরদাতা এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় দরদাতাদের বাদ দিয়ে ১ কোটি টাকা বেশি দিয়ে একই ব্র্যান্ডের সড়কবাতির প্রকল্পটি সর্বোচ্চ দরদাতা কে কেন দেয়া হলো এবং সর্বনিম্ন দরদাতা অভিযোগ দিয়েছেন তারপর কেন চুক্তি হলো জানতে চাইলে
হাটহাজারী পৌরসভার সহকারী প্রকৌশল সালমা খাতুন বলেন, আমি তো সব কিছু জানি না! বেলাল সাহেব সবই জানেন। তবে হয়তো তাদের কোন অভিজ্ঞতা নেই তাই বাদ পড়েছেন। এরপর যার অভিজ্ঞতা আছে তিনি বা তার প্রতিষ্ঠান কি অভিজ্ঞতা নিয়ে জন্মায়েছে নাকি কাজ করেই অভিজ্ঞতা হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, কেউ তো অভিজ্ঞতা নিয়ে জন্ম গ্রহণ করেন না। তারপরও আমি বেলাল স্যার এবং পিডির সাথে আলোচনা করে আপনাকে জানাবো। তবে কোন প্রকার কাগজপত্র দিতে পারব না।
হাটহাজারী পৌর প্রশাসক এবং উপজেলা সহকারী ভুমি কমিশনার শাহেদ আরমান কে কয়েকবার মোবাইলে ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি।
সর্বনিম্ন দরদাতা এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় দরদাতাদের বাদ দিয়ে ১ কোটি টাকা বেশি দিয়ে একই ব্র্যান্ডের সড়কবাতির প্রকল্পটি সর্বোচ্চ দরদাতা কে কেন দেয়া হলো এবং সর্বনিম্ন দরদাতা অভিযোগ দিয়েছেন তারপর কেন চুক্তি হলো জানতে চাইলে ওয়াল্ড ব্যাংকের কোভিড-১৯ প্রকল্পের পিডি নাজমুল সাদাত মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান জানান, এখানে কোন অভিযোগ কিংবা সর্বনিম্ন দরদাতা হলে তাকে কাজ দিতে হবে তা না এবং টাকা বেশি তার কোন সমস্যা নেই।
স্থানীয় সরকার বিভাগের নগর উন্নয়ন-১ এর অধিশাখার যুগ্ম সচিব আবুল খায়ের মোহাম্মদ হাফিজুল্লাহ খান বলেন, এ বিষয়ে আমরা অবগত না। আপনি কাগজপত্র গুলো আমাকে দেন। তারপর আমি দেখছি।