
বিশেষ প্রতিবেদক
গত দুদিন ধরে আবারও উত্তপ্ত বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় -ববি- আবারও উপাচার্যের পদত্যাগ দাবীতে আন্দোলনে নেমেছেন শিক্ষার্থীরা। ববি উপাচার্য শুচিতা শারমিন এর পদত্যাগের একদফা দাবীতে এই আন্দোলন করছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তার বিরুদ্ধে আওয়ামীপন্থী শিক্ষক, ছাত্রলীগকে পুর্নবাসন এবং সহযোগিতার একাধিক অভিযোগ শিক্ষার্থীদের। অন্যদিকে আন্দোলনের নামে ভাংচুর ও অসদাচরণের অভিযোগ তুলে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন উপাচার্য শুচিতা শারমিন। এ নিয়ে ১৬ ফেব্রুয়ারী রবিবারও ববি শিক্ষার্থীরা আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে।
জুলাই বিপ্লবে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে গত বছর ২০ আগস্ট বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের -ববি- উপাচার্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূইয়া। এরপর গত ২৩ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান ঢাবি অধ্যাপক ড. শুচিতা শরমিন। উপাচার্য পদে যোগদানের পর থেকেই একের পর এক ইস্যুতে প্রশ্নের মুখে পড়েন শুচিতা শরমিন।
জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এছাড়াও ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র করছে বিরোধী দল”, এমন দাবি করে ২০২৩ সালের ২৩ নভেম্বর ৩৫০ বিশিষ্ট নাগরিক ও শিক্ষক যে বিবৃতি দিয়েছিলেন, সেখানে ড. শুচিতা শরমিনের নাম ছিল ১০৮ নম্বরে।
তিনি ববিতে যোগদানের পর থেকেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিরোধিতাকারী আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষকদের নিয়ে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছেন। এই শিক্ষকরা গত আগস্টে নানা অভিযোগে তৎকালীন উপাচার্য ড. বদরুজ্জামানের পাশাপাশি প্রক্টর, প্রভোস্টসহ প্রায় ১৯টি গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন।
শুচিতা শারমিন ববিতে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পতিত স্বৈরাচার ও ফ্যাসিস্টদের দোসরদের পক্ষের শক্তিকে পুনরায় নিয়োগ দিয়ে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের জনমতকে তোয়াক্কা না করে বিভিন্নভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থবিরতা তৈরি করেছেন বলে উপাচার্যের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ উঠেছে।
এর মধ্যে পরিকল্পনা উন্নয়ন দপ্তরের উপ-পরিচালক মিজানুর রহমানকে ভিসির একান্ত সচিব পদে নিয়োগ দিয়েছেন তিনি। এই মিজানুর রহমান আওয়ামী লীগ আমলে বরিশাল সিটি কর্পোরেশন এর মেয়র নির্বাচনে আবুল খায়ের আবদুল্লাহর হয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিয়ে বিতর্কিত হয়েছিলেন।
এছাড়াও আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ রেজিস্ট্রার মনিরুল ইসলামকে মেয়াদ শেষেও স্বপদে বহাল রেখেছেন তিনি।
অন্যদিকে, ছাত্রলীগ কর্মীকে সিকিউরিটি রুমের দরজা ভেঙ্গে ছিনিয়ে নেওয়ায় অভিযুক্ত ছাত্রলীগ কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেও গরিমসী করছেন উপাচার্য শুচিতা শারমিন। ববিতে জুলাই বিপ্লবের সময় ছাত্র আন্দোলন দমাতে সক্রিয় ভূমিকায় ছিলেন তৎকালীন প্রক্টর ড. আব্দুল কাইয়ুম, শিক্ষক সমিতির সভাপতি আব্দুল বাতেন চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক তারেক মাহমুদ আবির। উপাচার্যকে বর্তমানে পিছন থেকে তারাই চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের। যা নিয়ে শিক্ষার্থীরা বারবার আপত্তি জানালেও সেসব কথায় কর্ণপাত করেননি উপাচার্য। বরং তাদেরকে নিয়েই সিন্ডিকেট মিটিং করছেন বলেই তার বাস ভবন ঘেরাও হয়েছে বলে জানান শিক্ষার্থীরা। তাদের অভিযোগ, নতুন করে সিন্ডিকেটে তাদের বসিয়ে উপাচার্য তার ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল করার পায়তারা করছেন।
এদিকে শিক্ষকদের একটি বিশ্বস্ত সূত্র বলছে, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও সাবেক প্রক্টর কাইয়ুম এর স্ত্রী ড.ইসরাত জাহানকে সিন্ডিকেট সদস্য করার পায়তারা করছে উপাচার্য। তাছাড়া সাবেক প্রক্টর ড. আব্দুল কাইয়ুম, শিক্ষক আব্দুল বাতেন চৌধুরী ও তারেক মাহমুদ আবির প্রমূখদের গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছেন উপাচার্য শুচিতা শারমিন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রফিকুল ইসলাম বলেন, কয়েকদিন আগে উপাচার্যবিরোধী একটি আন্দোলন হয়েছিল। সেখানে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কারের জন্য ২২টি দাবী দেওয়া হয়েছিল। সেই সময় উপাচার্য বলেছিলেন, তিনি সব দাবি পূরণ করবেন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি কোনও কথাই রাখেননি। তাই শিক্ষার্থীদের এখন এক দফা, উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে এই কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
এদিকে আরেকটি সূত্র জানায়, সম্প্রতি উপাচার্য দপ্তর নিয়োগ পাওয়া জাহাঙ্গীর কবির রাহাত, প্রকৌশল দপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মুরশীদ আবেদীন, প্রকৌশলী মামুনুর রশীদ এর নেতৃত্ব কর্মকর্তাদের একটি গ্রুপ উপাচার্যের পদত্যাগ ঠেকাতে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। এদের পিছন থেকে কলকাঠি নাড়ছে শিক্ষকদের একটি অংশ কাইয়ুম ও বাতেন গ্রুপ।
শুক্রবার শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভা স্থগিত হয়ে যায়। তবে এতে ক্ষীপ্ত হয়ে উপাচার্য শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দেন। ফলে শিক্ষার্থীরাও ছয় দফা দাবী তুলে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এই ছয় দফা বাস্তবায়ন করতে না পারলে অবিলম্বে উপাচার্যের পদত্যাগ দাবী করেছেন তারা। দফাগুলো হচ্ছে –
১. মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও নিয়ম বহির্ভূত আওয়ামী ফ্যাসিস্ট রেজিস্ট্রারকে বহাল রেখে অসাধু সুবিধা দেওয়ার জন্য পাতানো গোপন সিন্ডিকেট সভার আহ্বান।
২. ২৯ জুলাই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হামলায় অংশ নেওয়া নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের আগাম জামিন পাওয়া ও ক্যাম্পাসে নিষিদ্ধ না হওয়া।
৩. নিয়মবহির্ভূতভাবে দুইজন সিন্ডিকেট সদস্যকে বাদ দিয়ে চিহ্নিত আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের নিয়ে পাতানো গোপন সিন্ডিকেটের নাটক মঞ্চস্থ করা।
৪. আইন ও সংবিধানের দোহাই দিয়ে আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের স্বপদে বহাল রেখে মূল পদে আনার ‘কুচক্রী পাঁয়তারা’ চালানো।
৫. গত ৬ মাসেও ২২ দফার কোনো রকম প্রতিফলন করতে ব্যর্থ হওয়া।
৬. ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের অবাধ বিচরণ, মাদক সেবন ও ভাঙচুরের বিরুদ্ধে প্রশাসন কোনো প্রকার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে ব্যর্থ হওয়া।
উপাচার্য যদি এসব দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তার অবস্থান পরিষ্কার না করেন তাহলে তাকে অনতিবিলম্বে পদত্যাগ করতে হবে বলে হুঁশিয়ারি দেন ববি শিক্ষার্থীরা।
এ বিষয়ে উপাচার্য শুচিতা শারমিন জানান, গত শুক্রবার উপাচার্যের বাসভবনে সিন্ডিকেট মিটিং চলাকালে ২৫ থেকে ৩০ জন শিক্ষার্থী আজেবাজে কথা বলে শ্লোগান দিচ্ছিল। এ সময় বাসভবনের লোহার গেট ভাংচুর করা হয়। জুলাই আন্দোলনের সময়ও এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি। সিন্ডিকেট সদস্যদের উপস্থিতিতে এ ধরনের ঘটনা ঘটানো হয়েছে। যা প্রত্যাশার বাইরে।
তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা আমার প্রানের জায়গায় রয়েছে। কিন্তু যারা এ ধরনের গন্ডগোল করেছে তাদেরকে ভিন্নভাবে দেখতে সরকার থেকে নির্দেশনা রয়েছে। শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীর যে আচরণ সেটা যদি আমি না দেখি তাহলেতো তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতেই হবে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পদ ও সন্মান নষ্ট করার মতো ঘটনা ঘটানো হয়েছে, সেক্ষেত্রে অবশ্যই মামলা হবে। মামলা প্রত্যাহার করতে হলে তাদেরকে আসতে হবে উপাচার্যের সাথে বসতে হবে। তাদের মধ্যে যদি অনুশোচনা হয় তাহলে অবশ্যই মামলা প্রত্যাহার হবে। আমিতো শিক্ষার্থীদের ক্ষতি করার জন্য বসি নাই। শিক্ষার্থীদের মধ্যে যেমন মানবিকতা ও উন্নয়ন কল্যান দেখতে চাই। তেমনি তাদের মধ্যে ধ্বংসাত্মক আচরণ দেখতে চাই না বলে জানান শুচিতা শারমিন।
উল্লখ্য, এর আগে গত বছর ২৭ নভেম্বর বিভিন্ন অভিযোগে উপাচার্যের পদত্যাগ চেয়ে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। সেই সময়ও তার কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। পরে শিক্ষার্থীদের দাবি পূরণে এক মাসের সময় নেন উপাচার্য।