
মো: আব্দুর রহিম,
বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন পাশ হয়েছে প্রায় দুই বছর আগে। এরপরে আর কোনো অগ্রগতি নেই। দীর্ঘসূত্রতায় আটকে আছে শরীয়তপুরের মানুষের স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়। আর কোনো কালক্ষেপণ নয়, দ্রুত ‘শরীয়তপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়’ বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন জেলার বিশিষ্টজনেরা।
আজ সোমবার(৩০ জুন) দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘শরীয়তপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন ফোরাম’ আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এ দাবি জানান।
ফোরামের সদস্য সচিব ও শিল্পপতি শিকদার মো. মেসবাহউদ্দিন স্বাগত বক্তব্যে বলেন, পদ্মাপাড়ের নৈসর্গিক এলাকার পলিমাটিতে একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের দীর্ঘদিনের আকুতি ছিল। ২০২১ সালে তৎকালীন সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় শরীয়তপুরে একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব পেশ করে। ২০২৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় আইনও পাশ করে সরকার। কিন্তু এরপরে আর কোনো অগ্রগতি নেই। এই জটিলতা নিরসনে আমরা এক সঙ্গে কাজ করতে চাই। শরীয়তপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়নে আপনাদের সবার সহযোগিতা চাই।
অনুষ্ঠানে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন ফোরামের আহ্বায়ক এবং আহসান উল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক রেজিস্ট্রার, শিক্ষাবিদ ও গবেষক ড. মোশাররফ হোসেন মাসুদ। তিনি লিখিত বক্তব্যে বলেন, শরীয়তপুরের মাটি খুব উর্বর। জেলার মানুষের আদিম ও প্রধান পেশা কৃষি। কঠোর পরিশ্রমী একদল সোনার মানুষের ছোঁয়ায় জেলায় ধান, পাট, গম, পেঁয়াজ, কালোজিরা, ধনিয়া, সরিষা, মিষ্টি আলু, টমেটো মাঠের পর মাঠ চাষ হয়। এর মধ্যে পাট, পেঁয়াজ, আদা, টমেটো প্রধান রপ্তানি পণ্য হিসেবে বিবেচিত। উর্বর কিন্তু অবহেলিত জনপদে কৃষিবিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে প্রাগ্রসর বিশ্বের সহিত সংগতি রক্ষা ও সমতা অর্জন এবং জাতীয় পর্যায়ে কৃষিবিজ্ঞানে উন্নত শিক্ষাদানের পাশাপাশি প্রাসঙ্গিক বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রচলিত অন্যান্য বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি এবং নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনসহ দেশে কৃষি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার সম্প্রসারণের নিমিত্তে শরীয়তপুর জেলায় একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ২০২১ সালের ৬ অক্টোবর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর নামে শরীয়তপুরে একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। এরপর ওই বছর ১২ অক্টোবর শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে খসড়া আইন প্রণয়ন করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে(ইউজিসি) একটি চিঠি দেওয়া হয়। কমিশন থেকে শেখ হাসিনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের খসড়া আইন প্রণয়ন করার পর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, অর্থ বিভাগ, জননিরাপত্তা বিভাগ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মতামত গ্রহণ করা হয়।
তিনি বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ হয়ে খসড়া আইনটি মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থাপন করা হয়। ২০২২ সালের ৯ জানুয়ারি তৎকালীন সরকারের ১০০৮ তম মন্ত্রিপরিষদ সভায় শেখ হাসিনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০২২ এর খসড়া নীতিগত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। এরপর ২০২৩ সালের ১২ জুন শেখ হাসিনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে দেশের ৯ম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও ৫৪তম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়’ নামকরণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। শরীয়তপুরে বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপনের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়। ২০২৩ সালের ১৩ নভেম্বর ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শরীয়তপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০২৩’ নামে একটি আইন সংসদে পাশ হয়। এই আইন পাস হওয়ার ফলে শরীয়তপুরে একটি নতুন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের আইনি ভিত্তি তৈরি হয়। অনুমতি পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপনের জন্য মাঠপর্যায়ের কাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল। দেশের কৃষিশিক্ষা, গবেষণা এবং সম্প্রসারণমূলক কার্যক্রম আরও বেগবান করতে চ্যান্সেলর ও ভাইস-চ্যান্সেলর নিয়োগ, সিন্ডিকেট, একাডেমিক কাউন্সিল গঠন এবং জমি অধিগ্রহণ শেষে দ্রুতই কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু জেলার ১৩ লাখ মানুষের ভাগ্যের নির্মম পরিহাস আইন পাশ হওয়ার পর আর কোনো কার্যক্রম শুরু হয়নি। ২০২৫ সালের ১৬ জানুয়ারি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিশ্ববিদ্যালয়টির নাম ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, শরীয়তপুর’ থেকে পরিবর্তন করে ‘শরীয়তপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়’ নামকরণ করে। এছাড়া আইন পাস হওয়া কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়নে গত প্রায় দুই বছরে আর কোনো অগ্রগতি নেই। এমতাবস্থায় ১৩ লাখের বেশি মানুষের আকাঙ্ক্ষিত এই দাবি বাস্তবায়নে আপনাদের সবার সহযোগিতা চাই।
ড. মোশাররফ হোসেন মাসুদ বলেন, শরীয়তপুরের মানুষের অর্থনৈতিক দীনতার মুখাপেক্ষী নয়, তারা কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নের মুখাপেক্ষী। তাদের মানবসম্পদ, অবকাঠামো ও যোগাযোগের উন্নয়ন প্রয়োজন। সেইসাথে পদ্মাপাড়ের মানুষ বিভীষিকাময় ভাঙন থেকে পরিত্রাণ চায়। এটাই জনদাবি। ঢাকার অদূরের এই জেলায় নেই সরকারি চিকিৎসা, শিক্ষা, প্রতিষ্ঠান কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়। ফলে বিপুল সম্ভাবনার জেলার মানবসম্পদ পিছিয়ে পড়েছে। জেলাবাসীকে টেনে তুলতে এখনই দরকার শরীয়তপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় দ্রুত বাস্তবায়ন। আগে আইন পাশ হওয়ার পরেও বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়নের জটিলতা নিরসনে আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করব। এক্ষেত্রে সবার সহযোগিতা চাই।
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন(ডিইউজে) সভাপতি শহিদুল ইসলাম বলেন, আইন পাশ হওয়ার পরেও একটি জন-আকাঙ্ক্ষার বিশ্ববিদ্যালয় এভাবে বাস্তবায়ন থেমে থাকতে পারে না। দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু করার দাবি জানাচ্ছি।
মোটেক্স ফ্যাশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদ কবির রানা বলেন, দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ তুলনামূলকভাবে অবহেলিত। দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে মাত্র একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। শরীয়তপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় দেশের ৯ম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে দ্রুত বাস্তবায়ন হোক। আর কোনো কালক্ষেপণ যেন না হয়। তিনি বলেন, এই বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়নের জটিলতা নিরসনে আমাদের তথ্যভিত্তিক উপায়ে কাজ করতে হবে। যাতে করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে বাস্তবতা যৌক্তিকভাবে তুলে ধরতে পারি।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ড. মোঃ আহসানউল্লাহ বলেন, শরীয়তপুর জেলার নাম শুনলেই মনে হয় প্রদ্বীপের নিচে অন্ধকার। ঢাকার এত কাছের জেলা কিন্তু অবহেলিত, নিগৃহীত জনপদ। আমার বিশ্বাস শরীয়তপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন হলে জেলার নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে। পলিমাটির উর্বর জেলায় কৃষিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে।
সিটি ইউনিভার্সিটির ব্যবসায় ও অর্থনীতি অনুষদের ডীন এবং ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. জুলফিকার হাসান বলেন, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের মৌলিক উপাদান হলো লাইভস্টক, এগ্রো বিজনেস আর ফিশারিজ। এই তিনের মেলবন্ধন হলো শরীয়তপুর। অসংখ্য নদী বয়ে গেছে জেলার বুক চিড়ে। বাড়িতে বাড়িতে সমন্বিত কৃষি। গোয়ালে গরু-ছাগল। পুকুরে মাছ আর ফসলি মাঠ জুড়ে ধান, গম, পাঠ, সবজি। জেলার ৬টি উপজেলাতেই পর্যাপ্ত বিস্তীর্ণ যায়গা আছে। সুবিধামত যেকোনো যায়গায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা সম্ভব। তাই আর কালক্ষেপণ নয় দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন জরুরি। এই দাবি সবসময় চালু রাখতে হবে। উপাচার্য, উপ-উপাচার্য এবং প্রকল্প পরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট পদগুলোতে দ্রুত নিয়োগ সম্পন্ন করে কাজ শুরু করতে হবে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. এম. নুরুল ইসলাম বলেন, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের যা যা উপযোগিতা থাকতে হয় শরীয়তপুরে তার সবগুণ বিদ্যমান। সরকারের কাছে এটা আমাদের দীর্ঘদিনের দাবিও ছিল। সেই দাবির প্রেক্ষিতে একটা বিশ্ববিদ্যালয় আইনও পাশ হয়েছে। তাহলে কেনো এই দীর্ঘসূত্রতা। এই বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়নে আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করব। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় জেলার সামগ্রিক চেহারা বদলে দিবে। এজন্য সবাই কাঁধে কাঁধ রেখে সরকারের দোরগোড়ায় দাবিটি পৌঁছে দেবো। আশা করি দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন হবে।
গোলটেবিল বৈঠকে আরও বক্তব্য রাখেন, পালং-জাজিরা ফোরামের সভাপতি মাওলানা খলিলুর রহমান, ধলপুর আদর্শ কলেজের অধ্যক্ষ আব্দুর রউফ বাচ্চু, অধ্যাপক এমএ শাহাবুদ্দিন, তরুণ ব্যবসায়ী ও শিক্ষানুরাগী সাইয়েদ জোবায়ের, ঢাকাস্থ শরীয়তপুর স্টুডেন্ট ওয়েলফেয়ারের সাবেক সভাপতি তাহমিদ জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যয়নরত জাজিরার শিক্ষার্থীদের সংগঠন পদ্মার সভাপতি রফিকুল ইসলাম প্রমুখ।