
মীর আব্দুল আলীম:
ঢাকা আজও গরম। পুরো বাংলাদেশটা তো বটেই! এটা রাজনীতির উত্তপ্ত। বাজারে নিত্যপণ্যের দাম যেমন বাড়ছে, তেমনি বেড়েছে মানুষের অস্থিরতা।
একই প্রশ্ন চারদিকে, ভোট হবে তো? হলে সুষ্ঠু হবে কি ? কেউ বলে “দেখা যাবে”, কেউ বলে “সব ঠিকই আছে”, কিন্তু মনের ভেতর জমে থাকা সংশয় কেউ ঝেড়ে ফেলতে পারছে না। বাংলাদেশের গণতন্ত্র আজ দাঁড়িয়ে আছে এক সঙ্কটসন্ধিক্ষণে।
পথটা যেন চেনা, কিন্তু গন্তব্য অনিশ্চিত। এই সময়েই দরকার সবচেয়ে বড় সত্যটা মনে রাখা- ‘সুষ্ঠু নির্বাচন ছাড়া গণতন্ত্র বাঁচে না’।
গণতন্ত্রের প্রাণ হচ্ছে ভোটাধিকার। গণতন্ত্র কাগজে লেখা শব্দ নয়। এটি মানুষের বিশ্বাসের আরেক নাম। মানুষ যখন ভোট দিতে পারে না, তখন রাষ্ট্রের প্রতি তাদের আস্থা ভেঙে পড়ে।
সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমেই নাগরিকরা রাষ্ট্রের অংশীদার হয়। যদি এই অংশীদারিত্ব কৃত্রিমভাবে দমিয়ে রাখা হয়, তাহলে গণতন্ত্রের শিকড় শুকিয়ে যায়। একটি দেশের সত্যিকারের উন্নয়ন শুরু হয় যখন মানুষ বিশ্বাস করে,
তার ভোটই নির্ধারণ করে কে রাষ্ট্র চালাবে। কিন্তু রাষ্ট্রের নাগরিকদের সে আশায় যেন গুড়ে বালি দীর্ঘ বছর ধরে।
অনির্বাচিত সরকারের মূল সমস্যা আস্থাহীনতা। ইতিহাস জানে, অনির্বাচিত সরকার কখনও টিকে না।
যে সরকার ভোটে নয়, কৌশলে ক্ষমতায় আসে,
তার শাসনকাঠামো ভিতরে ভিতরে পচে যায়। জনগণের আস্থা হারিয়ে ফেলা মানে রাষ্ট্রীয় নীতি প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া। যেখানে আস্থা নেই, সেখানে উন্নয়ন হয় না, হয় কৃত্রিম প্রদর্শনী। আস্থার শূন্যতা থেকেই জন্ম নেয় অবিশ্বাস, বিরোধিতা, বিদ্রোহ।
অতীতের ছায়া এখনো বর্তমান। গত ১৫ বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসে আমরা দেখেছি ভোটবিহীন নির্বাচন,
‘রাতের ভোট’, ‘বন্দুকের নিচে ভোট’, আর প্রশাসনিক ভোটযজ্ঞ।
ফলাফল? সেতো ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছামাফিক ফল। জনগণ ভোট দিতে আগ্রহ হারাচ্ছে।
যখন মানুষ ভোটকেন্দ্রে যায় না, তখন গণতন্ত্র থাকে শুধু বইয়ের পাতায়।
একটি সমাজ তখন ভেতরে ভেতরে নীরব বিদ্রোহে ফেটে পড়ে।
এই অনীহা যদি এখনই না থামানো যায়, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গণতন্ত্রকেই ভণ্ডামি ভাববে।
নিরপেক্ষ ভোট মানে ভারসাম্যপূর্ণ সংসদ। যেখানে সংসদে কেবল তোষামোদির কণ্ঠ প্রতিধ্বনিত হয়, সেখানে গণতন্ত্রের নিঃশ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে। সংসদ তখন আর জনগণের আওয়াজের মঞ্চ থাকে না, পরিণত হয় ক্ষমতাসীনদের প্রশংসা সংগীতের মঞ্চে। এই নীরব সংসদ গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেয়। একটি সুষ্ঠু ভোট মানে কেবল ভোটকেন্দ্রের শান্ত পরিবেশ নয়, বরং তা মানে, সংসদে নানামতের প্রতিফলন, ভিন্ন কণ্ঠের উপস্থিতি, এবং জনগণের সব শ্রেণির প্রতিনিধি একসাথে বসার সুযোগ। এমন সংসদই সরকারের চোখে আয়না ধরতে পারে, ভুল সিদ্ধান্তে সতর্কবার্তা দিতে পারে, নীতি প্রণয়নে ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে। শক্তিশালী বিরোধী দল মানেই রাষ্ট্রের নিরাপদ দিকনির্দেশনা। বিরোধী দল থাকলে সংসদের প্রতিটি আলোচনায় একধরনের যুক্তি ও জবাবদিহি তৈরি হয়। তাদের প্রশ্ন সরকারকে জাগিয়ে রাখে, তোষণ নয়, দায়বদ্ধতার সংস্কৃতি গড়ে তোলে। তাদের উপস্থিতি সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ নয়, বরং জাতির জন্য আশীর্বাদ। কিন্তু যেখানে সংসদ একদলীয়, যেখানে সমালোচনা মানে শত্রুতা, সেখানে আর কোনো নীতি টেকে না, টিকে থাকে শুধু মনোপলি। একচেটিয়া ক্ষমতা মানুষকে অন্ধ করে, রাষ্ট্রকে দুর্বল করে, এবং গণতন্ত্রকে শ্বাসরুদ্ধ করে তোলে।
গণতন্ত্রের সৌন্দর্য তার বৈচিত্র্যে। যেখানে মতের মিল না থাকলেও সম্মান থাকে, যেখানে ভিন্নমতকে দমন নয়, বরং সহাবস্থানের সুযোগ দেওয়া হয়। নিরপেক্ষ ভোট সেই পথ খুলে দেয়,
যেখানে জনগণের ভোটই সত্যিকার অর্থে সংসদের শক্তি হয়ে ওঠে,
আর ভারসাম্যপূর্ণ সংসদই গণতন্ত্রকে জীবিত রাখে।
একক ক্ষমতা মানে দুর্নীতির উর্বর ক্ষেত্র। যখন ক্ষমতা এক হাতে, তখন জবাবদিহিতা হারায়। দীর্ঘমেয়াদি একদলীয় আধিপত্য প্রশাসনের কাঠামোকে পক্ষপাতদুষ্ট করে তোলে। অফিস থেকে আদালত, সব জায়গায় “দলীয় যোগসূত্র” হয়ে দাঁড়ায় মাপকাঠি।
এমন রাষ্ট্রে যোগ্যতা নয়, আনুগত্য টিকে যায়। ফল দুর্নীতি, দমননীতি ও বিচারহীনতার বিস্তার ঘটে।
ভয়মুক্ত ভোটই প্রকৃত স্বাধীনতা। ভয় যদি বুথ পর্যন্ত পৌঁছে যায়, তাহলে স্বাধীনতার মানে থাকে না। ভোটার যখন ভাবে “এই ভোট দিলে ক্ষতি হবে”, তখন সে গণতন্ত্রে অবিশ্বাসী হয়। প্রশাসন ও মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষতা না থাকলে
জনগণের ইচ্ছা কাগজে হারিয়ে যায়। ভোট দেওয়ার পরিবেশ যদি নিরাপদ না হয়,
তাহলে ‘গণতন্ত্র’ শব্দটাই ফাঁকা হয়ে যায়।
প্রশাসনকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে। আজ দেশের প্রশাসনিক কাঠামো অনেকাংশেই রাজনৈতিক রঙে রঞ্জিত।আগেও ছিল, এখনো তাই বদলাইনি এতটুকু।
যেখানে কর্মকর্তা মনে করেন তাঁর পদোন্নতি নির্ভর করছে “কার প্রতি আনুগত্যে”, সেখানে নিরপেক্ষতা আশা করা বৃথা। নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা শুধু কাগজে নয়, কাজে লাগাতে হবে। তারা যেন কোনো ফোনকল নয়, সংবিধানের কাছে জবাবদিহি করে, এই সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনতে হবে।
সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে মর্যাদা হারাবে দেশ। বিশ্বের চোখ এখন বাংলাদেশের দিকে।
যে দেশ একসময় গণতন্ত্রের দৃষ্টান্ত ছিল, আজ সে দেশকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে মানবাধিকার ও ভোটাধিকার নিয়ে।
একটি প্রহসনের নির্বাচন মানে বিশ্বমঞ্চে আস্থা হারানো। ফলে বিনিয়োগ কমবে, কূটনৈতিক সম্পর্ক দুর্বল হবে, বাংলাদেশ হারাবে তার মর্যাদার আসন।
আসন্ন জাতীয় সংসদের ভোট নিয়ে বিদেশি প্রতিক্রিয়া ইতোমধ্যেই সতর্ক সংকেত দিচ্ছে। আমেরিকা, ইউরোপ, এমনকি প্রতিবেশী দেশগুলিও উদ্বেগ প্রকাশ করছে।
ভিসা নীতি, নিষেধাজ্ঞা, এসব এখন বাস্তব হুমকি।
বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্রবাসী কর্মসংস্থান, রপ্তানি, এমনকি আন্তর্জাতিক সহযোগিতাও কমে যাবে। বিশ্বকে বোঝাতে হলে প্রথমে নিজেদের স্বচ্ছতা দেখাতে হবে।
যুবসমাজের দেশত্যাগ, অসুস্থ রাজনীতির প্রতিচ্ছবি। আজ তরুণরা বিদেশমুখী।
তাদের চোখে এই দেশ আর সম্ভাবনার নয়, বরং অনিশ্চয়তার প্রতীক। তারা মনে কর যোগ্যতা নয়, দলীয় পরিচয়ই ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে। এই মানসিকতা জাতির সবচেয়ে বড় ক্ষতি।
দেশ হারাচ্ছে তার প্রতিভাবান প্রজন্মকে, যারা একদিন এই জাতির ভিত্তি হতে পারত।
অর্থনীতি ও গণতন্ত্র দুই চাকা এক গাড়ির। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া অর্থনীতি টেকে না।
যখন ভোট নিয়ে সংঘাত হয়, তখন বিনিয়োগ থেমে যায়। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা প্রথমে যে জিনিস দেখে তা হলো, আইন ও ন্যায়ের নিশ্চয়তা। সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে সেই আস্থা ফেরানো অসম্ভব। গণতন্ত্রে সংকট মানে অর্থনীতিতে ধস।
মুক্ত গণমাধ্যমই সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রাণ। যেখানে সাংবাদিক ভয়ে লিখতে পারে না, সেখানে সত্য মরে যায়। নির্বাচনের আগে গণমাধ্যমের কাজ হলো, সত্য উদ্ঘাটন, ক্ষমতার জবাবদিহি নিশ্চিত করা। মামলা, ভয়ভীতি আর বিজ্ঞাপন-বঞ্চনায় যদি সংবাদ দমিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে ভোটও আর স্বাধীন থাকে না। একটি স্বাধীন সংবাদপত্রই পারে সুষ্ঠু নির্বাচনের বাতিঘর হতে।
নির্বাচন কমিশনের তাই সাহস! যেখানে সাহসই সাফল্য। সংবিধান কমিশনকে স্বাধীন বলেছে, কিন্তু সাহস দিয়েছে কি? কমিশনকে শুধু আইনি ক্ষমতা নয়, নৈতিক দৃঢ়তাও দরকার। তারা যদি ভয় পায়, তাহলে পুরো প্রক্রিয়া অকার্যকর। প্রয়োজনে আইন সংশোধন করে কমিশনকে আরো শক্তিশালী করতে হবে। যেন তারা সরকারের নয়, সংবিধানের প্রতি দায়বদ্ধ থাকে।
জনগণই রাষ্ট্রের মালিক। জনগণের অধিকার ফিরিয়ে দিন। রাষ্ট্র জনগণের, শাসক শ্রেণির নয়।
যখন ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়, তখন রাষ্ট্র নিজের নাগরিকদেরই পর করে দেয়। এই অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া মানেই রাষ্ট্রে নতুন প্রাণ সঞ্চার।
ভোট মানে কেবল সংখ্যা নয়- সেটি মানুষের মর্যাদা, পরিচয়, বিশ্বাস।
সুষ্ঠু নির্বাচনই স্থিতিশীলতার গ্যারান্টি। গণতন্ত্র যদি নড়বড়ে হয়, অর্থনীতি কাঁপবে, সমাজ ভাঙবে, আস্থা হারাবে মানুষ। নিরপেক্ষ ভোট মানে শান্ত সমাজ, স্থিতিশীল রাষ্ট্র। একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনই পারে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে। সেখানেই রয়েছে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। মনে রাখতে হবে ভোট যদি বেঁকে যায়, গণতন্ত্র ভেঙে যায়
শেষ কথা: সুষ্ঠু নির্বাচন এখন কোনো রাজনৈতিক দাবির বিষয় নয়,
এটি জাতির অস্তিত্বের প্রশ্ন। রাষ্ট্র, সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং নাগরিক সমাজ,
সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে এই বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে। অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনই বাংলাদেশকে ফেরাবে গণতন্ত্রের উজ্জ্বল পথে।
♦ মীর আব্দুল আলীম
সাংবাদিক কলামিস্ট, মহাসচিব-কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ।www.mirabdulalim.com


মীর আব্দুল আলীম 




















