
মোরশেদ আলম,
আজকের তরুণ সমাজ নানা বিভ্রান্তি ও অনিশ্চয়তার মধ্যে পথ খুঁজে ফিরছে। লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত যুবক-যুবতী কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা না পেয়ে হতাশায় ডুবে যাচ্ছে। কেউ কেউ অবক্ষয়ের পথে পা বাড়াচ্ছে। সরকার বদলাচ্ছে, কিন্তু মানুষের জীবনের মৌলিক সমস্যা থেকে যাচ্ছে একই জায়গায়। শ্রমিক বঞ্চিত হচ্ছে ন্যায্য মজুরি থেকে, কৃষক পাচ্ছে না ফসলের ন্যায্য দাম। শিক্ষা ও চিকিৎসা সবার নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। বাকস্বাধীনতা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। রাজনীতি পরিণত হয়েছে কেবল ক্ষমতার খেলায়। আর এই সুযোগে দেশের সম্পদ তুলে দেওয়া হচ্ছে বিদেশি লুটেরাদের হাতে।
এই বাস্তবতায় তরুণদের মনে প্রশ্ন জাগে— কে আমাদের পথ দেখাবে? কোন রাজনীতি আমাদের মুক্তি দিতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তরে ফিরে তাকাতে হয় ইতিহাসের বুকে খচিত এক সংগ্রামী নারীর দিকে, যিনি ছিলেন এক সাহসিনী, এক অনড় বিপ্লবী, এক কমিউনিস্ট — কমরেড অণিমা সিংহ।
১৯২৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জের এক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন অণিমা সিংহ। বাবা ছিলেন চিকিৎসক, মা শিক্ষিত ও প্রগতিশীল। ছোটবেলা থেকেই দুই ভাইয়ের মাধ্যমে যুক্ত হন ব্রিটিশবিরোধী রাজনীতিতে। সিলেট মেডিক্যাল কলেজে পড়ার সময় সক্রিয়ভাবে ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। সামাজিক রক্ষণশীলতার গণ্ডি ভেঙে মায়ের সহায়তায় রাজনীতির ময়দানে নামেন। ছাত্রজীবনে মার্কসবাদে দীক্ষা নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন। তখন থেকেই তাঁর লক্ষ্য ছিল স্পষ্ট— শ্রমিক, কৃষক, মেহনতি মানুষের মুক্তি।
গ্রামে গ্রামে ঘুরে, কৃষকদের ঘরে ঘরে, মাঠে-ময়দানে লড়াই করে তিনি গড়ে তোলেন কৃষক আন্দোলনের ভিত্তি। ১৯৫০ সালে টংক প্রথার বিরুদ্ধে হাজং কৃষকদের ঐতিহাসিক বিদ্রোহে তিনি সম্মুখভাগে নেতৃত্ব দেন। পুলিশি ধরপাকড়, অনাহার, পাহাড়ে আত্মগোপন— সব বাধা পেরিয়ে তিনি পৌঁছে যান প্রতিরোধের অগ্নিকেন্দ্রে। যখন পুলিশ এলাকা ঘিরে ফেলে, তখনও তিনি রাতের অন্ধকারে সেই ঘেরাও ভেঙে প্রবেশ করেন— প্রতিরোধের আগুন জ্বালাতে।
পাকিস্তান সরকার বাধ্য হয় টংক প্রথা বাতিল করতে, কিন্তু তখন কমিউনিস্ট পার্টিকেও করে নিষিদ্ধ। শুরু হয় দমন-পীড়ন, পরিবার দেশত্যাগে বাধ্য— কিন্তু অণিমা সিংহ দেশ ছাড়েননি। তিনি আত্মগোপনে থেকেও পড়াশোনা চালিয়ে যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। গোপনে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন বিপ্লবী কমরেড মণি সিংহের সঙ্গে— যেন দুটি বিপ্লবী নদীর মিলন ঘটে এক মোহনায়।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি যান ত্রিপুরায়, শরণার্থী শিবিরে সংগঠক হিসেবে কাজ করেন। দেশ স্বাধীন হলে তিনি বাংলাদেশ কৃষক সমিতির সম্পাদিকা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে নিজ হাতে রুটি বানিয়ে বিতরণ করেন— কারণ তাঁর কাছে বিপ্লব মানে শুধু মিটিং-মিছিল নয়, মানুষের কষ্টে পাশে দাঁড়ানো, ক্ষুধার্থের মুখে খাবার তুলে দেওয়া।
কমরেড অণিমা সিংহ আজও প্রাসঙ্গিক— কারণ তিনি ছিলেন নিপীড়িত জনগণের পক্ষে দাঁড়ানো বিকল্প রাজনীতির প্রতীক। তিনি দেখিয়ে গেছেন, নারী মানেই দুর্বল নয়— নারীও হতে পারে বিপ্লবের অগ্রসেনানী। তিনি শিখিয়েছেন, কৃষক-শ্রমিকের পাশে দাঁড়াতে হলে তাদের জীবনের অংশ হয়ে উঠতে হয়। তিনি প্রমাণ করেছেন, বিপ্লব কেবল ক্ষমতা দখলের লড়াই নয়, এটি আদর্শ, আত্মত্যাগ আর ন্যায়ের পক্ষে অটল থাকার সংগ্রাম।
কমরেড অণিমা সিংহ শেখান বাস্তব সংগ্রামের চর্চা। তিনি আজকের তরুণদের জন্য প্রেরণা, যারা সমাজ বদলাতে চায়, যারা বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়তে চায়, যারা বুঝতে চায়— কমিউনিজম মানে কেবল তাত্ত্বিক চর্চা নয়, এটি জীবনযাপন, এটি মানুষ গড়ার কাজ।
১৯৮০ সালের জুন মাসে এক সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে ১ জুলাই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর জীবন আমাদের শেখায়— নিজের অধিকার আদায় করতে হলে লড়াই করতে হয়, বাধা যত কঠিন হোক, সংগ্রাম ছাড়া কোন মুক্তি নেই। আপনার শিক্ষার অধিকার, আপনার শ্রমের মূল্য, ফসলের ন্যায্য দাম, চিকিৎসা, বাসস্থান— সবকিছুর জন্য লড়াই করতে হবে, সংগঠিত হতে হবে। এইটাই কমরেড অণিমা সিংহের শিক্ষা। এইটাই কমিউনিস্ট রাজনীতির পথ।
তিনি অমর, তিনি প্রেরণা, তিনি চেতনার দীপ্ত আগুন। আজ তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে বিনম্র শ্রদ্ধা,
বিপ্লবী কমরেড অণিমা সিংহ- লাল সালাম ।