
মোঃ রুবেল খান মোংলা বাগেরহাট
সরকারী ভাবে দস্যু মুক্ত ঘোষিত সুন্দরবনে আবারও মাথাচাড়া উঠেছে বনদস্যুরা। এরই মধ্যে চাঁদার দাবীতে কয়েক দফায় বনজীবিদের উপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। বনদস্যুরা গত এক মাসে অপহরণ করে অর্ধশতাধিক জেলেকে। মুক্তিপণ নিয়ে কিছু জেলে ছাড়া ফেলেও এখনও অনেক জেলে জিম্মি রয়েছে দস্যুদের কাছে। এমন পরিস্থিতিতে পেশা বদলাচ্ছেন বনজীবীরা। এর ফলে বনবিভাগের রাজ্বস্ব আদায় কমেছে অর্ধেকের নিচে।
এক সময় ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন ছিলো অপহরণ, ডাকাতিসহ নানা অপরাধের অভয়ারণ্য। তখন প্রায় বনদস্যু বাহিনী গুলোর কাছে জিম্মি হতে হতো জেলেদের। চাহিদামতো চাঁদা দিলে মিলতো মুক্তি,আর নয়তো মৃত্যু। জিম্মি বনদস্যুদের উদ্ধারে তখন প্রায় গহীনবনে অভিযান চালাতো আইনশৃংখলা বাহিনী। ওই সময় অনেক দস্যুর মৃত্যুও হয়েছে ক্রসফায়ারে আবার আহত হয়েছে অনেক আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্য। এক পর্যায়ে ২০১৬ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সুন্দরবনের ৩২টি বাহিনীর প্রধানসহ ৩২৪ জন দস্যু তাদের কাছে থাকা অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করেছিলো। এর পর ২০১৮ সালে সুন্দরবনকে দস্যু মুক্ত ঘোষনা করে সরকার। কিন্তু দস্যুমুক্ত বলা সেই সুন্দরবনে এখন প্রায় ঘটছে জেলেদের উপর হামলার ঘটনা। মুক্তি পনের দাবিতে অসহায় জেলেদের জিম্মি করছে দস্যুরা। গেল ২৭ জানুয়ারী কমান্ড স্টাইলে সুন্দরবনের দুবলারচর সংলগ্ন এলাকায় জেলেদের উপর হামলা চালিয়ে তাদের জিম্মিকরার চেষ্টা করে বনদস্যু দয়াল বাহিনীর সদস্যরা। এসময় জেলেরা একত্রিত হয়ে অস্ত্রসহ ৩ বনদস্যুকে ধরে কোস্টগার্ড সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করে।
এর আগে বিছিন্ন ভাবে দুইএক জন করে জেলে জিম্মি করলেও এ ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে পরের দিন ১৫ জেলেকে জিম্মি করে ওই দস্যুরা। অপহরণের ১৭ দিন পর মাথা পিছু দুই লাখ ৮৫ হাজার টাকা মুক্তিপণ দিয়ে বাড়ি ফিরেছেন নয়জন জেলে। মুক্তিপণ নিয়ে জেলেদের চোখ বেধে বুধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) রাতে সাতক্ষীরার শ্যামনগরের মুন্সিগঞ্জ এলাকায় জঙ্গল থেকে উপরে উঠিয়ে দিয়ে যায় বনদস্যু দয়াল বাহিনীর সদস্যরা। বৃহস্পতিবার ভোর রাত ৩টার দিকে তারা নিজ নিজ বাড়িতে পৌঁছায়।
ফিরে আসা জেলেরা হলেন, অজাহারুল ইসলাম, আলমগীর হোসেন, হাফিজুর রহমান, মোঃ শাহীনুর আলম, মোঃ রাসেল, মোঃ শাহাজান ঢালী, নুরে আলম ও শাহ্ আলম। মুক্তিপণের টাকা দিতে না পারায় এখনো ৬ জনকে আটক রেখেছে ডাকাতরা।
মুক্তিপন দিয়ে ছাড়া পাওয়া জেলে শাহীনুর আলম জানান,জিম্মিকরে বনদস্যুরা তাদেরকে অনেক মারধর করে। এমন অবস্থায় তারা আর সুন্দরবন যাবেন না বলে জানান তিনি।
মোংলা উপজেলার চিলা ইউনিয়নের বাসিন্দা জেলে অমৃত বৈরাগী জানান, দস্যু মুক্ত হওয়ার পর এক সময় অনেক জেলে সুন্দরবন যেত নির্ভয়। কিন্তু এখন দস্যুতা শুরু হওয়ায় বর্তমানে তারা পেশা পরিবর্তন করে অন্য কাজ করা শুরু করে দিয়েছেন। অনেক জেলে এখন দিনমজুরের কাজ করতে শুরু করেছেন।
মোংলা পৌর শহরের কলেজ রোডের বাসিন্দা আবদুল মজিদ বলেন, তারা গত কয়েক বছর সুন্দরবনে গিয়ে যা আয় করেছেন, তা দিয়ে তাদের সংসার চলেছে। কিন্তু বর্তমানে দস্যুতা বেড়ে যাওয়ায় বনে আর যাচ্ছেন না।
দস্যুদের দৌরাত্ব বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে কোস্টগার্ড পশ্চিমজোনের অপারেশন কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার তারেক আহম্মেদ জানান, তারা নিয়মিত অভিযান অব্যাহত রেখেছেন। কিছু অপরাধীকে আটক করতে সক্ষম হয়েছেন।
এদিকে পর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই স্টেশন কর্মকর্তা মিল্টন রায় জানান, সুন্দরবনে দস্যুতা ভয়াবহ আকার ধারন করেছে বলে জেলেরা আমাদের জানিয়েছেন। তাই এখন বনজীবীরা সুন্দরবনে যাচ্ছেন না। তাই রাজ্বস্ব আদায় নেমেছে অর্ধেকের নিচে।
তিনি আরো জানান, ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের ১৫ দিনে চাঁদপাই স্টেশন থেকে ৪৭৮টি পাশ পারমিট দেওয়া হয়েছিলো বনজীবীদের। আর ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের ১৫ দিনে সেখানে পারমিট দেওয়া হয় মাত্র ২৩৬ টি। অর্থাৎ ২৪২টি পাশ কমেছে। এমন অবস্থায় রাজ্বস্ব আদায় কমেছে অর্ধেকের নিচে।