
বিশেষ প্রতিনিধি:
ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের দুস্কর্মের সহযোগী, সাবেক মন্ত্রী পরিষদ সচিব শফিউল আলমের প্রভাব বলয় কাজে লাগিয়ে কোটি কোটি টাকা মূল্যের ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি জবরদখল করে নিয়েছেন তাঁরই আপন ভাতিজা ও কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম। ভূঁয়া জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ও ভূঁয়া ওয়ারিশ সনদ বানিয়ে ভূঁয়া ব্যক্তিকে দাতা ও সাক্ষী বানিয়ে প্রথমে তৈরি করেন দলিল ও খতিয়ান। পরে জালিয়াতি সেই খতিয়ান দেখিয়ে নিরীহ মানুষের মূল্যবান জমির দখল নেন এই জাহাঙ্গীর আলম। আর এভাবে নিরীহ মানুষজনের প্রায় ২০ কোটি টাকা মূল্যের দুই একর সম্পত্তি জবরদখল করে রেখেছেন দীর্ঘদিন ধরে। দেশের পটপরিবর্তন হলেও তার দখলদারিত্ব এখনও শেষ হয়নি।
এমন অভিযোগ তুলে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দ্বারস্থ হয়েছেন উখিয়া উপজেলার হলদিয়া পালং ইউনিয়নের রুমখাপালং এলাকার রশিদ আহমদের ছেলে রফিকুল আলম মাহমুদ। এমন ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কক্সবাজার জেলা প্রশাসককে লিখিত ভাবে নির্দেশনা দিয়েছেন। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন ইতোমধ্যে বিষয়টি তদন্ত করার জন্য অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (রাজস্ব) নির্দেশ দিয়েছেন।
ভূক্তভোগী রফিকুল আলম মাহমুদ দাবি করেন, জাহাঙ্গীর আলমের তৈরি করা ভূঁয়া ওরারিশ সনদ হলদিয়া পালং ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আমিনুল হক আমিন বাতিল করেছেন। একই সাথে ভূঁয়া জাতীয় সনদও তদন্তে ধরা পড়েছে। জবরদখল করা জমির ভূঁয়া দলিলের কথিত সাক্ষীরা আদালতে হলফনামা দিয়ে বলেছেন, তারা সাক্ষী ছিলেন না এবং দলিলের স্বাক্ষরও তাদের নয়।
অভিযোগ মতে, উখিয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রী পরিষদ সচিব শফিউল আলমের ভাতিজা জাহাঙ্গীর আলম নিজের চাচার প্রভাব খাটিয়ে ভূঁয়া দলিল সৃজন করে নিরীহ মানুষজনের জমি দখল করেন। তিনি ভূঁয়া ওয়ারিশ সনদ, জাতীয়তা সনদ ব্যবহার করে জমির দাতা সাজিয়ে দলিল বানিয়ে জমি দখলের প্রমাণ তদন্তে মিললেও এখনও পর্যন্ত ‘ক্ষমতার প্রভাবে’র কারণে জাহাঙ্গীর আলমের টিকিটিও স্পর্শ করতে পারেননি নিরীহ জমির মালিকরা।
ওই জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে রয়েছে, তিনি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের চট্টেশ^রী রোডের শাহগাজী লেইনের প্রনব কুমার রায় চৌধুরীকে উখিয়ার রত্মাপালং এলাকার মৃত সত্যেন্দ্র বিজয় রায় চৌধুরীর ওয়ারিশ সাজিয়ে প্রথমে একটি ভূঁয়া ওয়ারিশ সনদ তৈরি করেন। এরপর একই নামে একটি জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ব্যবহার করে (এনআইডি ১৫১১৮৯৫৫৫০৭২৮) উখিয়া সাব রেজিস্ট্রার অফিসে প্রনব কুমারের কাছ থেকে ২.১ একর জমি রেজিস্ট্রি করেন। এরপর ওই জালিয়াতি দলিল দিয়ে একটি খতিয়ানও সৃজন করেন।
পরে বিষয়টি জানতে পেরে জমির প্রকৃত মালিক রশিদ আহমদ কথিত ওই জমিদাতা প্রনব কুমারের পরিচয় চ্যালেঞ্জ করে আদালতে মামলা করেন। পরে আদালতের নির্দেশে বিষয়টি তদন্ত করে ওই পরিচয়পত্র ও ঠিকানায় ভিন্ন ব্যক্তিকে পাওয়া যায়।
এদিকে প্রকৃত বিষয়টি জানতে পেরে ২০০৯ সালের ২০ অক্টোবর হলদিয়া পালং ইউনিয়ন পরিষদের তৎকালিন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আমিনুল হক আমিন প্রণব কুমারের নামে ইস্যু হওয়া ওয়ারিশ সনদটি বাতিল করে দেন। ওয়ারিশ সনদ বাতিলকালে তিনি উল্লেখ করেন, ‘আমার শিক্ষিত বন্ধু ১. শাহ আলম ২. নুরুল আলম ৩. শামসুল আলম, সর্বপিতা- মৃত সৈয়দ হোছাইন, আমাকে ভুল তথ্য দিয়ে ইতিমধ্যে একটি ওয়ারিশ সনদ নিয়ে যায়। পরবর্তীতে জানতে পারলাম যে, সুরেন্দ্র বিজয় রায় চৌধুরীর ছেলে প্রনব কুমার রায় চৌধুরীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, বহু বছর ধরে এলাকায় যার দেখা নেই। ভুলবশত: সম্পুর্ণ ওয়ারিশখানা না পড়ে দস্তখত করে ভুল করেছি। আমার ওয়ারিশ সনদ খানা সর্বক্ষেত্রে বাতিল বলিয়া গন্য হবে।’
অন্যদিকে প্রনব কুমারের নামে যে এনআইডি কার্ড তৈরি করা হয়, সেটিও ভুঁয়া বলে প্রমাণিত হয় তৎকালিন জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও রেজিষ্ট্রেশন অফিসার মোহাম্মদ ফরহাদ হোসেনের তদন্তে। তদন্ত প্রতিবেদনে প্রনব কুমারের নামে ব্যবহৃত এনআইডি নম্বরটি চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার সাতবাড়িয়া ইউনিয়নের আহমদ নবীর স্ত্রী সাকী আকতারের বলে উল্লেখ করা হয়।
এ বিষয়ে উখিয়া উপজেলার তৎকালিন সহকারি কমিশনার (ভূমি) এ এইচ এম আসিফ বিন ইকরাম এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, সুরেন্দ্র বিজয় রায় চৌধুরীর ছেলে প্রনব কুমার দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই দেশত্যাগ করেন। খতিয়ান সৃজন করার সময় তথ্য গোপন করায় অনিচ্ছাকৃত ভুলক্রমে খতিয়ান করা হয়। পরে নোট করার সময় ভুল ধরা পড়ায় ওই খতিয়ান বাতিলের সুপারিশ করা হয়।
অনুপমা রায় চৌধুরীর ওয়ারিশ মিলন রায় গং হতে জমি কেনেন কক্সবাজার জেলার সম্ভ্রান্ত পরিবারের এক ব্যক্তি। সেই জমি রেজিষ্ট্রি করার সময় জাহাঙ্গীর আলমের জালিয়াতি নজরে আসায় ওই সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিও তার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করেন।
এ বিষয়ে সরকার পরিবর্তনের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ভূক্তভোগী রফিকুল আলম মাহমুদ সবকিছু উল্লেখ করে লিখিত অভিযোগ দেন। ওই অভিযোগের প্রেক্ষিতে চলতি বছরের ১৯ মে কক্সবাজার জেলা প্রশাসককে তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেয়। ওই নির্দেশনা পেয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন বিষয়টি তদন্ত করার জন্য পহেলা জুন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (রাজস্ব) দায়িত্ব দেন।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন জানান, বিষয়টির তদন্ত চলছে। এখন শেষ পর্যায়ে রয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া গেলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
প্রসঙ্গত, স্থানীয়দের অভিযোগ মতে- চাচার ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে সাধারণ মানুষের সম্পদ দখলকারি জাহাঙ্গীর আলম ছিলেন পেশায় একজন রঙমিস্ত্রি। কিছুদিন সৌদিতে প্রবাসে থেকেও একই কাজ করেছেন। দেশে ফিরে ২০১৯ সালে তিনি চাচা সাবেক মন্ত্রী পরিষদ সচিব শফিউল আলমের প্রভাব খাটিয়ে অবৈধ ভোটে উখিয়া উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ওই নির্বাচনের সময় তিনি নির্বাচনী হলফনামায় স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের তথ্য গোপন করে নিজের সম্পদের মূল্য দেখান মাত্র ১২ লাখ টাকা। কিন্তু বর্তমানে তার অবৈধ সম্পদের পরিমাণ শতকোটি টাকা।