
তৌহিদুল ইসলাম চঞ্চল,
কলামিস্ট,
মানবসম্পদ–শ্রম ও মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ:
দৃশ্যপট এক-** রাজধানী ঢাকার ব্যস্ত একটি মোড়ে আটকে রয়েছে একটি অ্যাম্বুলেন্স। আর সেই অ্যাম্বুলেন্সটির ভীতরে একটি শিশুর জীবন রয়েছে অনিশ্চয়তায়। ডাক্তার বলেছেন, তাকে যদি এখনই চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া না যায়, তাহলে হয়তো সে তার জীবনের স্রোতটি চিরতরে হারিয়ে ফেলবে। মা-বাবা হারাবেন তাদের আদরের এই সন্তানকে। অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন একটানা বাজছে। আর এর বাইরে অসুস্থ শিশুটির বাবা দাঁড়িয়ে অচেনা শঙ্কা ও বিষণ্ণ মনে তাকিয়ে আছে সামনে থাকা জনস্রোতের দিকে। যেখানে একজন ব্যক্তি হাতে মাইক নিয়ে উচ্চস্বরে বক্তৃতা দিচ্ছেন। আর ক্ষণে ক্ষণে সামনে থাকা শ্রোতারা করতালি আর স্লোগানে মুখরিত করে রেখেছে আকাশ-বাতাস। দুধের শিশুর জীবন বাঁচাতে মরিয়া এক অসহায় পিতার কাছে প্রতিটি তালি যেন গভীর আঘাতে হৃদয়ের রক্তক্ষরণ আর একেকটি স্লোগান যেন হায়েনার ডাক মনে হচ্ছে। চারিদিকে হাজার হাজার যানবাহন আটকে আছে কখন এই জট খুলবে বলা যাচ্ছে না। হাসপাতালটি নিকট দূরত্বে হলে এই পিতা ছেলেকেন কোলে নিয়েই রওয়ানা দিতেন! পরিস্থিতির কাছে হেরে যাওয়া এই পিতা অপেক্ষায় আছেন কখন বড় নেতা ভাষণ দিবেন, কখন এই রাজনৈতিক অবস্থানের সমাপ্তি ঘটবে।
দৃশ্যপট দুই – রংপুর থেকে ঢাকাগামী মহাসড়ক সেখানে আটকে রয়েছে রহিম উদ্দিনের সারা জীবনের পরিশ্রমের ফসল! কাঁচামাল নিয়ে দিনাজপুর থেকে ঢাকা আসছিলো একটি ট্রাক। পথিমধ্যে শ্রমিকদের সড়কে অবস্থানের জন্য যা আটকে রয়েছে। এখানেও রয়েছে জট খোলার অবিশ্চয়তা! এদিকে রহিম শীতের রাতেও ঘামছেন। কারণ এই মালামাল দিয়েই তার ছোট্ট ব্যবসাটি চলে। এই ট্রাক শুধু একটি পণ্যবাহী গাড়ি নয়, এটি তার পরিবারের স্বপ্ন, তার কর্মীদের রুটিরুজির প্রতীক। এই ট্রাকের গন্তব্যে পৌঁছানোর ওপর নির্ভর করছে এতোগুলো মানুষের ভবিষ্যৎ।
এ যেন দুটি ফসলী জমিতে ফসল শুকিয়ে মৃতপ্রায়। না, অনাবৃষ্টি জাতীয় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে নয়।। এর কারণ কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর অবস্থান। তাদেরও হয়তো কোনো দাবি আছে, কোনো বঞ্চনার কষ্ট আছে। তাদেরও মনে হয়েছে, দাবি আদায় করতে গেলে এই রাস্তা বন্ধ করে কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি আদায় করা যাবে।
এই এই দুটি ঘটনা রুপক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। এটি আসলে আমাদের সমাজের বর্তমান চিত্রের এক বাস্তব প্রতিফলন। গণতন্ত্রে প্রতিবাদ একটি স্বীকৃত অধিকার এবং, সেই প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে অবস্থান কর্মসূচি বা অবরোধ এখন এক সাধারণ কৌশল। কিন্তু এই অবস্থান যখন সড়কে জনজীবনের স্বাভাবিক গতিকে স্তব্ধ করে দেয়, তখন তা অধিকার আদায়ের চেয়ে বেশি জনদুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই নিবন্ধে আমরা কীভাবে বিভিন্ন গোষ্ঠী তাদের অবস্থান কর্মসূচির মাধ্যমে অবরোধ সৃষ্টি করছে, এর ফলে সৃষ্ট ক্ষতি এবং এর থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের দায়িত্বশীলতার ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করব।
দাবি কেন উঠছে: যৌক্তিকতা, অযৌক্তিকতা ও কৌশল
অবরোধের পেছনের কারণগুলো সব সময় যে যৌক্তিক, তা নয়। অনেক সময় এমন কিছু দাবি সামনে আসে যা দেখে মনে হয় রাষ্ট্র যেন কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি। বঞ্চিত বা বৈষম্যের শিকার মানুষের দাবি থাকতে পারে—এটা স্বাভাবিক। কিন্তু সেই দাবি আদায়ের জন্য যেখানে-সেখানে মানুষের দুর্ভোগ সৃষ্টি করা বা জনজীবন অচল করে দেওয়া কতটা গ্রহণযোগ্য, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। অনেকেই কথায় কথায় ‘জনগণের’ নামে আওয়াজ তোলেন, কিন্তু সেই ‘জনগণের’ দুর্ভোগের তোয়াক্কা করেন না। এই ধরনের মনোভাব আসলে দাবি আদায়ের চেয়ে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে বেশি।
অবস্থান থেকে সৃষ্ট অবরোধের বহুমুখী ক্ষতি
আন্দোলনকারীদের এই অবস্থান কর্মসূচি থেকেই নগর জীবনে, অর্থনীতিতে এবং জরুরি সেবায় ব্যাপক ক্ষতি হয়।
• নগর জীবনে চরম দুর্ভোগ: যখন আন্দোলনকারীরা রাস্তা দখল করে অবস্থান নেয়, তখন সব ধরনের যানবাহন চলাচল থেমে যায়। ফলে অফিসগামী মানুষ, ছাত্র-ছাত্রী এবং সাধারণ জনগণ দীর্ঘ সময় ধরে রাস্তায় আটকে থাকে। একটি অবস্থানের কারণে অনেক সময় পুরো শহরের ট্র্যাফিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে।
• অর্থনৈতিক ক্ষতি: আন্দোলনকারীদের এই অবস্থান পণ্য পরিবহনকে পুরোপুরি অচল করে দেয়। কারখানায় কাঁচামাল পৌঁছায় না, উৎপাদিত পণ্য বাজারে পাঠানো যায় না। এর পাশাপাশি, বিগত সরকারের সীমাহীন অর্থপাচার ও দুর্নীতির মতো বিষয়গুলো দেশের অর্থনীতির ওপর যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল, তা বর্তমান অস্থিরতাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। ফলে ব্যবসায়ী ও কৃষকদের বিপুল লোকসান হয়।
• রোগী ও জরুরি সেবায় বাধা: সবচেয়ে মানবিক দিকটি হলো, আন্দোলনকারীদের এই অবস্থানের কারণে মুমূর্ষু রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্স আটকে যায়। জরুরি চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে পৌঁছাতে না পেরে রোগীর, এমনকি শিশু বা গর্ভবতী নারীর জীবনহানির মতো মর্মান্তিক ঘটনাও ঘটে।
• আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি: অবস্থান কর্মসূচি অনেক সময় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটায়। জুলাই অভ্যুত্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি জনগণের যে অবিশ্বাস ও অনাস্থা তৈরি হয়েছে, তার ফলে এই বাহিনীকে পরিস্থিতি সামাল দিতে আরও বেশি বেগ পেতে হচ্ছে। হবে না কেন নাই কথাতেই মানুষ পুলিশকে দুষছে যাচ্ছেতাই বলছে। এটাই কি তবেঁ বাক স্বাধীনতা? এর ওপর আবার আমাদের শেষ আশ্রয় দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে দিনের পর দিন ছোটখাটো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মাঠে থাকতে হচ্ছে। যার ফলে রাষ্ট্রের সমস্ত শক্তি এখন আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে মাঠে রয়েছে। আর কোন তুরুপের তাস হাতে নেই!
এতসব মনুষ্যসৃষ্ট ঘটনার মাঝে আইনশৃঙ্খলার কীভাবে উন্নতি ঘটবে এবং অর্থনীতি কীভাবে স্থিতিশীল হবে?
আইনশৃঙ্খলা ও অর্থনীতির স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য কয়েকটি মৌলিক বিষয় নিশ্চিত করা জরুরি:
• জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার: আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি জনগণের অবিশ্বাস দূর করতে হলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে পেশাদারিত্বের সাথে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে।
• দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান: অর্থনীতির স্থিতিশীলতার জন্য অর্থপাচার ও দুর্নীতির মতো গভীর সমস্যাগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। এতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা ফিরবে এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্বাভাবিক হবে।
• বিকল্প প্রতিবাদের পথ: আন্দোলনকারীদেরও দায়িত্বশীল হতে হবে। তাদের এমন কর্মসূচি বেছে নেওয়া উচিত যা জনজীবনকে জিম্মি না করে দাবি আদায়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
অবস্থান থেকে উত্তরণ: দায়িত্বশীলতা ও সহনশীলতার পথ
এই সমস্যার সমাধান করতে হলে আন্দোলনকারী এবং সাধারণ মানুষ উভয়েরই দায়িত্বশীল হতে হবে। দাবি আদায়ের জন্য রাস্তা অবরোধ করে অবস্থান নেওয়ার পরিবর্তে এমন পদ্ধতি খুঁজে বের করা উচিত যা মানুষের জীবনকে বিপন্ন করবে না।
• বিকল্প প্রতিবাদের পথ: দাবি আদায়ের জন্য অবস্থান কর্মসূচি পালন করা যেতে পারে, তবে সেটি কোনো নির্দিষ্ট স্থানে (যেমন: প্রেস ক্লাব বা কোনো মাঠ) হতে পারে, যা সাধারণ মানুষের চলাচলে বিঘ্ন ঘটাবে না।
• দায়িত্বশীল নাগরিকের ভূমিকা: আমাদের দাবি থাকতেই পারে, কিন্তু সেই দাবিতে আমাদের এমন কিছু করা উচিত নয় যা অন্য মানুষের জীবন ও জীবিকাকে বিপন্ন করে। একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে আমাদের সবারই উচিত এমন একটি পথ খুঁজে বের করা যেখানে প্রতিবাদ হবে, কিন্তু জনভোগান্তি হবে না।
অবস্থান কর্মসূচি বা অবরোধের পেছনে অধিকার আদায়ের যে আকাঙ্ক্ষা থাকে, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেই অধিকার আদায়ের প্রক্রিয়া যেন অন্য কোনো নাগরিকের অধিকারকে ক্ষুণ্ন না করে, তা নিশ্চিত করা আমাদের সবার সম্মিলিত দায়িত্ব। একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে আমাদের কথায় কথায় অবস্থান-অবরোধ, যমুনা ঘেরাও, শাহবাগ চলো, লংমার্চ, শর্ট মার্চ, এটা চাই-ওটা চাই—এসব বন্ধ করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। আর অন্যের দুর্ভোগ কমাতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না আমাদের কৃতকর্ম একদিন আমাদের জন্য অভিশাপ হতে পারে।