কালিয়াকৈর (গাজীপুর) প্রতিনিধি।।
” ডান হাতে তাজা গ্রেনেড আমার , বাম হাতে রাইফেল । বিদ্রোহী আমি মুক্তিপিয়াসী- প্রাণ সদা উদ্বেল । আমি তোমাদের চেনা - আমি যে মুক্তি সেনা ”। রাজধানী ঢাকার অদুরে গাজীপুর জেলার ঐতিহৃবাহী চৌরাস্তায় মুক্তিযোদ্ধের স্বারক ভাস্কর্য ” জাগ্রত চৌরঙ্গী ”সেই দীর্ঘ অর্ধশতাধিক বছর পূর্বের স্বাধীনতা সংগ্রামের অজানা ইতিহাসের নিরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে । বর্তমানে স্বাধীনতার অজানা কতো কাহিনী নিয়ে মুক্তিযোদ্ধের ইতিহাস লেখা হচ্ছে । অথচ মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে দেশের সর্বপ্রথম ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ গাজীপুরের জয়দেবপুরে পাক-হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশ্স্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলার মধ্যে শত স্মৃতি ও হৃদয়স্পর্শী প্রকৃত ঘটনা স্থান পাচ্ছে না । ১৯৭১সালের ১৯ মার্চ, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন । সারাদেশব্যাপী স্বত:স্ফুর্ত শ্লোগান উঠেছিল ” জয়দেবপুরের পথ ধর – বাংলাদেশ স্বাধীন কর ” । উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষনার পূর্বেই ১৯ মার্চ ঐতিহাসিক জয়দেবপুরে শুরু হয়েছিল বাংলাদেশে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ । এই জয়দেবপুর থেকেই গর্জে উঠেছিল পাক-হানাদারদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার জন্য সরাসরি বন্দুক যুদ্ধ । দেশের সমগ্র জাতিকে সেদিন জয়দেবপুরবাসী দেখিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের পথ । আর মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার বজ্র শপথে বলিয়ান করে তুলেছিল । তাই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে জয়দেবপুর তথা গাজীপুরবাসীর কৃতিত্বপূর্ণ এবং গৌরবময় ভুমিকা চির অম্লান ।
পাক-হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধে দেশের প্রথম গাজীপুরবাসীর অস্ত্র গর্জে উঠেছিল মৌলিক ও নায্য দাবি আদায়ের লক্ষ্যে । আমাদের জাতীয় জীবনের সর্বোৎকৃষ্ট ও মহিমান্বিত দিনটি উজ্জল হয়ে উঠেছে এ মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। মুক্তিযুদ্ধকালীন ৯ মাসের কঠিন আর কঠোর রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামে লক্ষ প্রাণের আত্মোৎসর্গের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমরা আর্জন করেছি বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন- সার্বভৌম বাংলাদেশ ।বিজয়ের গৌরবোদ্বীপ্ত ও মহিমান্বিত দিনটি এক অবিস্মরণীয় তাৎপর্যে আজও গাজীপুরের জয়দেবপুরে স্মৃতি ” জাগ্রত চৌরঙ্গী ” সূর্যালোকের ন্যায় উজ্জল হয়ে আছে আমাদের জাতীয় জীবনে ।
গাজীপুরবাসী বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবজনক ইতিহাস রচনা করতে সক্ষম হয়েছে । এখানকার স্বাধীনতাকামী বীর – জনতা দেশ গঠনের বিাভন্ন আন্দোলন – সংগ্রামে পালন করেছে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা । তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খাঁন ১ মার্চে এক অন্য দেশের মাধ্যমে ৩ মার্চ -এ নির্ধারিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষনা করে । ফলে গাজীপুরের জয়দেবপুর , কালিয়াকৈর ও টঙ্গী সহ জেলার সর্বত্র স্বত:স্ফূর্তভাবে সর্বস্তরের বিক্ষোব্দ জনতা প্রতিবাদ মিছিল নিয়ে রাজপথে বেড়িয়ে পড়েছিল । মুক্তিযুদ্ধের সুচণালগ্নে গাজীপুর হয়ে ওঠে অগ্নিগর্ভ । স্বাধীনতার অদম্য স্পৃহায় এলাকার জনসাধারণ উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। ৩ মার্চ নজীরবিহীন হরতাল পালিত হয় । মার্চ ৪ ,৫ , ৬ তারিখে জেলার বিভিন্ন স্থানে জনসভা -সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয় । ৫ মার্চ টঙ্গীতে ১২ হাজার শ্রমিক- জনতার মিছিলের ওপর নির্বিচারে ও বিনা উস্কানিতে ইপিআর-এর সৈন্যরা গুলিবর্ষন করলে শ্রমিক নেতা আব্দুল মোতালেব সহ ৫ জন শহীদ হন এবং ৩০ জন অহত হয় । পাকসেনারা ৪ জনের লাশ আত্মগোপন করে । এমনি ভাবে নানা মর্মস্পর্শী ঘটনা উদ্বেগ ও উৎকন্ঠার মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত হয়ে ঐতিহাসিক ১৯ মার্চ এসে উপস্থিত হয় ।
এদিকে চান্দনা চৌরাস্তায় বিক্ষোব্ধ জনতার মুর্হুমূহু শ্লোগানে আকাশ-বাতাস যখন প্রকম্পিত তখন দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি ৩ টনি ট্রাক টাঙ্গাইল থেকে জয়দেবপুরে ফিরছিল । ট্রাকে সিদ্দিকুর রহমানের নেতৃত্বে পাঁচজন বাঙ্গালী সৈনিক ছিলেন , তাদের প্রত্যেকের হাতে ছিল এস.এম.জি । জনগনের প্রতিরোধের মনোভাব বুঝতে পেরে তাদের সাথে সৈনিকরা একাত্বতা ঘোষণা করে পাকসেনাদের উপর সরাসরি গুলিবর্ষণ শুরু করেন । ফলে শুরু হয় পাল্টা গুলি । পাক সেনাদের বিরুদ্ধে এটাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সশস্ত্র গুলিবর্ষণের ঘটনা ।
এই সম্মুখ যুদ্ধে হুরমত আলী নামে এক সাহসী যুবক ( ফুটবল খেলোয়াড় ) এক পাক সেনাকে ঝাঁপটে ধরে তার রাইফেল ছিনিয়ে নেন । কিন্তু সে রাইফেল চালাতে ব্যর্থ হওয়ায় পাকসেনার গুলিতে ঘটনাস্থলেই শহীদ হন । বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে হাজার বছরের চিরায়িত জাতির ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা । উল্লেখ্য যে,১৯ মার্চ সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্বে অংশগ্রহণ ও সর্ব দলীয় সংগ্রাম কমিটির আহবায়ক ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী এ্যাড. আ.ক,ম মোজাম্মেল হক ( এম,পি) ।