
তৌহিদুল ইসলাম চঞ্চল,
কলামিস্ট, মানবসম্পদ–শ্রম ও মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ
জেলা শহরের একটি স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়া দশ বছর বয়সী শিশু হায়াতের এখন বার্ষিক পরীক্ষার শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতিতে মনোযোগ দেওয়ার কথা। কিন্তু কচি মনে একটাই চিন্তা—পরীক্ষায় ভালো ফল না করলে বাবা-মা রাগ করবেন। কারণ তার মা এলাকার অন্যদের কাছে বলে রেখেছেন যে, “আমার হায়াত ফার্স্ট ছাড়া সেকেন্ড কখনও হয় না”। অগোচরে সেই কথোপকথন শোনা হায়াতের টেনশন এখন আকাশছোঁয়া।
কিন্তু হায়! সন্ধ্যার পর থেকে সভা, সমাবেশ, মাহফিলসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাইকের বিকট শব্দে সে কিছুতেই পড়ায় মন বসাতে পারছে না। নিজের পড়া কানে না পৌঁছলে যার মুখস্থ হয় না, সেই হায়াত আজ দিশেহারা। তার সরল মনে প্রশ্ন জাগে, “যে আঙ্কেলরা এই প্রোগ্রামগুলো করছেন, তাদের সন্তানরা কি পরীক্ষা দিচ্ছেনা!”
মাইকের এই বিকট শব্দ কিছুক্ষণ নয়, চলে রাত ১টা-২টা পর্যন্ত। ফলে হায়াতের ঘুমও ঠিকমতো হচ্ছে না, ভোরে উঠে পড়াও অসম্ভব হয়ে পড়েছে। শুধু হায়াত নয়, তার সত্তর বছর বয়সী হৃদরোগে আক্রান্ত দাদু ঘুমের মাঝে হুটহাট করে জেগে উঠছেন, আর সাত মাস বয়সী ছোট বোন হুমায়রা মাইকের শব্দের সাথে সাথে কান্নার শব্দ করছে। হায়াতের এই করুণ গল্প আমাদের সমাজের এক চরম স্বেচ্ছাচারিতা ও ব্যর্থতাকে নির্দেশ করে।
শব্দদূষণের ভয়াবহতা ও জনস্বাস্থ্যে আঘাতঃ
শব্দদূষণ (Noise Pollution) আজ এক নীরব মহামারীর আকার নিয়েছে। এটি কেবল বিরক্তি উদ্রেককারী নয়, জনস্বাস্থ্যের জন্য চরম ক্ষতিকর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) অনুযায়ী, শব্দদূষণ পরিবেশগত ঝুঁকি হিসেবেও বিবেচিত।
শারীরিক ও মানসিক প্রভাব:
- শ্রবণশক্তির ক্ষতি: মাইকের বিকট শব্দ বা ১০০ ডেসিবলের বেশি যেকোনো শব্দ দীর্ঘসময় কানে গেলে চিরতরে শ্রবণশক্তি হারানোর ঝুঁকি থাকে।
- হৃদরোগ ও রক্তচাপ: সত্তরোর্ধ্ব হায়াতের দাদুর মতো হৃদরোগীরা শব্দদূষণে সবচেয়ে বেশি ভোগেন। হঠাৎ উচ্চ শব্দ রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয় এবং হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।
- মানসিক চাপ ও ঘুমহীনতা: শিশুদের মনোযোগ ও স্মৃতিশক্তির ওপর সরাসরি আঘাত হানে শব্দ। এটি ঘুম চক্রকে ব্যাহত করে, যা মানসিক চাপ, ক্লান্তি ও অস্থিরতা সৃষ্টি করে। শিশু হায়াতের মতো শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার ফল খারাপ হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়।
আমাদের স্বেচ্ছাচারিতা ও আইনের লঙ্ঘন
হায়াতের মতো শত শত মানুষের দুর্ভোগের মূল কারণ হলো আমাদের সামাজিক স্বেচ্ছাচারিতা এবং বিদ্যমান আইনকে তোয়াক্কা না করার মানসিকতা। আমরা নিজেদের প্রয়োজনেই অন্য মানুষের অধিকার ও কষ্টের কথা ভুলে যাই।
স্বেচ্ছাচারিতার দিক:
- অতি উৎসাহী প্রচার: রাজনৈতিক সভা, ধর্মীয় মাহফিল বা বাণিজ্যিক প্রচারণায় আয়োজকরা নিজেদের বার্তা জোরেশোরে পৌঁছাতে গিয়ে শব্দের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করেন না।
- আইন না মানার প্রবণতা: বাংলাদেশে শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬ থাকলেও তা মানার ক্ষেত্রে চরম উদাসীনতা দেখা যায়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোরও এক্ষেত্রে শিথিলতা পরিলক্ষিত হয়।
- শিশুদের প্রতি সংবেদনহীনতা: পরীক্ষার সময় একজন শিক্ষার্থী বা একজন অসুস্থ বৃদ্ধের কষ্টের প্রতি ন্যূনতম সংবেদনশীলতা দেখানো হয় না।
শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬ অনুসারে, আবাসিক এলাকায় দিনের বেলা ৫০ ডেসিবল এবং রাতে ৪০ ডেসিবলের বেশি শব্দ করা দণ্ডনীয় অপরাধ। স্কুল, হাসপাতাল বা আদালতকে কেন্দ্র করে ১০০ মিটার পর্যন্ত এলাকা নীরব এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। এই এলাকায় শব্দসীমা দিনে ৪৫ ডেসিবল ও রাতে ৩৫ ডেসিবল। এই আইন অমান্য করলে প্রথমবার এক মাস কারাদণ্ড বা অনধিক পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড এবং পরবর্তী সময়ে আইন অমান্য করলে ছয় মাস কারাদণ্ড বা দশ হাজার টাকা জরিমানা হতে পারে।
করণীয় ও সম্মিলিত উদ্যোগ
শিশু হায়াতের মানসিক শান্তি ফিরিয়ে আনা এবং দেশের জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা করার জন্য কঠোর আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সামাজিক উদ্যোগ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি:
- আইনের কঠোর প্রয়োগ: স্থানীয় প্রশাসন এবং পুলিশকে অবশ্যই রাত ১০টার পর বা নীরব এলাকায় শব্দযন্ত্র ব্যবহারে কঠোর হতে হবে। আইন ভঙ্গকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
- সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন: সরকারি উদ্যোগে শব্দদূষণের স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে ব্যাপক প্রচার চালাতে হবে। এটি প্রচার করতে হবে যে, উচ্চ শব্দে মাইক ব্যবহার করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।
- আয়োজকদের দায়িত্বশীলতা: সভা-সমাবেশ আয়োজনের ক্ষেত্রে অবশ্যই শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (Sound Limiter) ব্যবহার করতে হবে এবং শুধুমাত্র সভার জায়গাতেই শব্দ সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। হায়াতের চিন্তা অনুযায়ী, শব্দ যেন বাইরে না ছড়ায়।
- জনগণের সজাগ ভূমিকা: জনগণকে শব্দদূষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে এবং প্রতিবাদের মাধ্যমে জনদুর্ভোগ সৃষ্টিকারীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।
- পরীক্ষার সময় বিশেষ সতর্কতা: শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং প্রশাসনকে সম্মিলিতভাবে পরীক্ষার সময়সূচি অনুযায়ী এলাকায় শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত বিশেষ নির্দেশনা জারি করতে হবে।
হায়াতের মতো শিশুদের মানসিক চাপমুক্ত একটি ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে এবং সমাজের শান্তি ও স্বাস্থ্য বজায় রাখতে আমাদের সকলেরই স্বেচ্ছাচারিতা ত্যাগ করে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।























