মোঃ আব্দুর রহিম শরীয়তপুর প্রতিনিধি,
জীবনে এগিয়ে যেতে অনেক সময় শুধু মেধা নয়, লাগে অদম্য সাহস আর অটুট মনোবল। সেই সাহস আর সংকল্পের প্রতিচ্ছবি শরীয়তপুরের রামভদ্রপুর ইউনিয়নের কার্তিকপুর গ্রামের তরুণ উল্লাস পাল। জন্মগত শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও জীবনের প্রতিটি ধাপে লড়াই করে জয়ী হয়েছেন তিনি। আর এবার তার সেই সংগ্রামের স্বীকৃতি মিলেছে প্রশাসন ক্যাডারে উত্তীর্ণ হওয়ার মাধ্যমে।
চাকরির জন্য একাধিক বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে শেষমেশ ৪৪তম বিসিএসে কাঙ্ক্ষিত প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন উল্লাস। এর আগেই তিনি ৪৩তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে উত্তীর্ণ হয়ে লেকচারার হিসেবে কর্মরত ছিলেন নড়িয়া সরকারি কলেজে। কিন্তু হৃদয়ের গহীনে লালিত স্বপ্ন ছিলো প্রশাসন ক্যাডার হওয়া। এবার তিনি তা অর্জন করেছেন।
উল্লাস পালের জন্ম মৃৎশিল্পী উত্তম কুমার পাল ও আন্না রানী পালের ঘরে। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে জন্ম নেওয়ায় দুই হাত ও দুই পা বাঁকা ছিলো তার। হাঁটতে শেখা, চলাফেরা, এমনকি লেখা সবই ছিলো ব্যতিক্রম। বাম হাতে লিখতেন তিনি।
১৯৯৯ সালে ভর্তি হন কার্তিকপুর পালপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বাবা তাকে প্রতিদিন স্কুলে পৌঁছে দিতেন। খেলাধুলা করতে না পারলেও পড়াশোনায় ছিলেন অসম্ভব মনোযোগী। ২০১০ সালে কার্তিকপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এ+ পেয়ে এসএসসি এবং ২০১২ সালে ঢাকা নর্দান কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। ঢাকা কলেজে পড়ার ইচ্ছা থাকলেও সুযোগ হয়নি শারীরিক কারণে।
পরবর্তীতে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগে। সেখানে থেকে বিবিএ ও এমবিএ সম্পন্ন করেন।
লড়াইটা শুধু পড়াশোনার না, ছিলো আত্মপ্রমাণেরও!
উল্লাস ৪০তম, ৪১তম ও ৪৩তম বিসিএসে অংশ নেন। ৪০তমতে উত্তীর্ণ হলেও পছন্দের ক্যাডার পাননি। ৪১তমতে সুপারিশ পান জুনিয়র ইন্সট্রাক্টর পদে। এরপর ৪৩তমতে শিক্ষা ক্যাডারে উত্তীর্ণ হয়ে যোগ দেন সরকারি কলেজে।
তবে তৃপ্ত হননি। বারবারই বলতেন, "আমি প্রশাসন ক্যাডার হবো।" অবশেষে ৪৪তম বিসিএসে সেই স্বপ্ন বাস্তব হলো।
‘নাম্বার মিলে যাওয়ার মুহূর্তে কান্না চলে আসে’ উল্লাস পাল বলেন,“রেজাল্টের পর যখন আমার রেজিস্ট্রেশন নম্বর মিলে যায়, চোখ দিয়ে পানি চলে আসে। আমি কখনো থেমে যাইনি। সমাজে অনেকেই ঠাট্টা করেছে, আবার অনেকেই পাশে থেকেছে। আমি চেয়েছি প্রশাসন ক্যাডারে যেতে, সেই লক্ষ্যে এগিয়ে গিয়েছি। আজ আমি সেখানেই পৌঁছেছি।”
তার মতে, প্রশাসন ক্যাডার হলো জনসেবামূলক ক্ষেত্র। তিনি চান রাষ্ট্র যে দায়িত্বই দিক, তিনি নিষ্ঠার সাথে তা পালন করবেন।
সমাজকে উল্টোপথে ভাবতে শেখানো একজন উল্লাস উল্লাস চান, প্রতিবন্ধী মানুষদের নিয়ে যেন সমাজের মানসিকতা বদলায়। তিনি বলেন,
“প্রতিবন্ধী কেউ সমাজের বোঝা নয়। বরং একটু সহযোগিতা পেলে তারাও পারে সমাজের জন্য কিছু করতে।”
পরিবার ও শিক্ষকেরা গর্বিত মা আন্না রানী পাল বলেন,“ছোটবেলা থেকেই ছেলেটা অনেক কষ্ট করেছে। আমরা সব সময় ওর পাশে ছিলাম। আজ ও প্রশাসন ক্যাডার হয়েছে, আমরা খুব গর্বিত।”
বাবা উত্তম কুমার পাল বলেন,“ওর লেখাপড়ার আগ্রহ এত বেশি ছিলো, আমরা কোনো কিছুতে কমতি রাখিনি। আজ ওর সাফল্যে আমরা কাঁদছি আনন্দে।”
প্রতিবেশী রূপক পাল বলেন,“উল্লাস দেখিয়ে দিয়েছে, শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সাফল্যের পথে বাধা নয়।”
কার্তিকপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক মো. হারুন অর রশিদ বলেন,
“উল্লাস পড়াশোনায় যেমন ভালো ছিলো, তেমনি ভীষণ আত্মসম্মানবোধ ছিলো ওর মধ্যে। আমরা গর্বিত যে এমন একজন ছাত্র আমাদের স্কুলের ছিলো।”
উল্লাসের গল্প শুধুমাত্র একজন বিসিএস ক্যাডারের সাফল্যের নয়, বরং হাজারো তরুণের জন্য এক অনুপ্রেরণার আলোকবর্তিকা।
যোগাযোগের ঠিকানাঃ মোল্লা ব্রিজ, যাত্রাবাড়ী, ঢাকা-১২০৪। মোবাইলঃ ০১৯১৮-৪০৪৭৬০, বিজ্ঞাপনঃ ০১৭৩৩-৩৬১১৪৮