শওকত আলম, কক্সবাজার
বাংলাদেশের উপকূলজুড়ে বাড়ছে প্লাস্টিক দূষণের মাত্রা। সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে উপচে পড়ছে বোতল, ব্যাগ, মোড়কসহ নানা ধরনের প্লাস্টিক বর্জ্য। এতে যেমন হুমকির মুখে পড়ছে সামুদ্রিক প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য, তেমনি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে স্থানীয় বাসিন্দা ও পর্যটকদের জীবনযাপনও। সম্প্রতি উপকূলীয় একটি সৈকতে তোলা একটি ছবিতে দেখা যায়, এক ব্যক্তি একাই সৈকত থেকে প্লাস্টিক বর্জ্য পরিষ্কার করছেন। এই একক প্রচেষ্টা যেমন প্রশংসনীয়, তেমনি তা আমাদের সামগ্রিক ব্যর্থতার প্রতিফলনও।
জাতিসংঘের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতি বছর পৃথিবীর সমুদ্রে প্রায় ৮০ লাখ টন প্লাস্টিক পড়ে। এর বড় একটি অংশ আসে অব্যবস্থাপনার কারণে। প্লাস্টিকের এই বিষাক্ত জাল ফাঁদে পড়ে যায় মাছ, কচ্ছপ, পাখিসহ অসংখ্য প্রাণী। বাংলাদেশের মতো উপকূলীয় দেশগুলোতে এর প্রভাব আরও ভয়াবহ—নদীর সঙ্গে সমুদ্রেও পৌঁছে যাচ্ছে শহর থেকে আসা অব্যবস্থাপিত বর্জ্য।
কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, কুয়াকাটা, মহেশখালী, ভোলা, খুলনার দ্বীপাঞ্চলসহ বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকায় সৈকতের চিত্র প্রায় এক—যত্রতত্র ছড়িয়ে থাকা প্লাস্টিক বর্জ্যে ঢেকে গেছে বালুকাবেলা। অতিরিক্ত পর্যটক প্রবাহ ও সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাবে প্রতিদিন বেড়েই চলেছে দূষণের মাত্রা।
প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে ভেঙে মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়, যা মাছ ও অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণীর শরীরে প্রবেশ করে। এই প্রাণীগুলো মানুষের খাদ্য তালিকায় থাকায়, পরোক্ষভাবে এই বিষাক্ত কণাগুলো মানবদেহেও প্রবেশ করছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, মাইক্রোপ্লাস্টিকের প্রভাবে দীর্ঘমেয়াদে ক্যান্সার, হরমোনজনিত সমস্যা ও প্রজনন ক্ষমতা হ্রাসের মতো স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হতে পারে।
সত্ত্বেও, মানুষ থেমে নেই। ছবির ওই ব্যক্তি, এবং তার মতো অনেকেই নিজ উদ্যোগে সৈকত পরিষ্কারে নামছেন। বিভিন্ন স্থানীয় সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবক দল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরাও সচেতনতামূলক অভিযানে অংশ নিচ্ছে। “সেভ দ্য বে”, “ক্লিন কক্সবাজার”, “গ্রিন বাংলাদেশ” ইত্যাদি সংগঠন নিয়মিত পরিষ্কার অভিযানের পাশাপাশি সচেতনতামূলক সেমিনার, ওয়ার্কশপ আয়োজন করে আসছে।
পরিবেশবিদ ও নীতিনির্ধারকদের মতে, এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন কিছু কার্যকর উদ্যোগ:
প্লাস্টিক নিষিদ্ধকরণ: সিঙ্গল-ইউজ প্লাস্টিক উৎপাদন ও ব্যবহার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
পরিবেশবান্ধব বিকল্প: পাট, কাগজ, কাঁচের তৈরি পুনর্ব্যবহারযোগ্য পণ্যের ব্যবহার বাড়ানো।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা: শহর ও উপকূলে সুনির্দিষ্ট বর্জ্য আলাদা করে সংগ্রহ ও রিসাইক্লিংয়ের ব্যবস্থা।
আইন প্রয়োগ: পরিবেশ আইন বাস্তবায়নে প্রশাসনের কঠোর মনোভাব।
সচেতনতা: স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পরিবেশ শিক্ষার অন্তর্ভুক্তি।
প্লাস্টিক দূষণ শুধু একটি পরিবেশগত ইস্যু নয়—এটি স্বাস্থ্য, জীববৈচিত্র্য ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অস্তিত্বের প্রশ্ন। একক বা ব্যক্তি উদ্যোগ প্রশংসনীয় হলেও প্রয়োজন রাষ্ট্রীয়, জাতীয় ও বৈশ্বিক সমন্বিত পদক্ষেপ। এখনই সময়, নিজেদের জীবন ও প্রকৃতিকে বাঁচাতে আমরা সবাই যেন দায়িত্ব নিই—অন্যথায়, দূষণের ঢেউয়ে একদিন হয়তো আমাদের অস্তিত্বও বিলীন হয়ে যাবে।
যোগাযোগের ঠিকানাঃ মোল্লা ব্রিজ, যাত্রাবাড়ী, ঢাকা-১২০৪। মোবাইলঃ ০১৯১৮-৪০৪৭৬০, বিজ্ঞাপনঃ ০১৭৩৩-৩৬১১৪৮