নজরুল ইসলাম লিখন ।।
চাঞ্চল্যকর যাত্রী হত্যার রহস্য উদঘাটন করেছে র্যাব-১১। গত ২১ জুলাই রূপগঞ্জ থানার টেংরারটেক এশিয়ান হাইওয়ে রোডের পশ্চিম পাশে মাল্টিব্রান্ড গ্রুপের বাউন্ডারি সংলগ্ন ডোবার মধ্যে ভাসমান অবস্থায় অজ্ঞাত এক ব্যক্তির লাশ পাওয়া যায়। গত ২৪জুলাই হাসপাতাল মর্গে উপস্থিত হয়ে মোঃ কাজল হোসেন (২১) নামক এক ব্যক্তি লাশের আলোকচিত্র, লাশের পরনে থাকা কাপড় দেখে লাশটি তার বাবা জাহিদুল ইসলাম বলে সনাক্ত করে।
এ ঘটনায় অজ্ঞাতনামা আসামীদের বিরুদ্ধে নিহতের ছেলে মোঃ কাজল হোসেন বাদী হয়ে রূপগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন, যার মামলা নং-৪০ (তারিখ-২৫/০৭/২০২১)। ঘটনার প্রকৃত রহস্য উদঘাটন ও ঘটনায় জড়িত অজ্ঞাতনামা আসামীদের গ্রেফতারে র্যাব-১১ এর একটি গোয়েন্দা দল ছায়া তদন্ত শুরু করে। র্যাব তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে উক্ত ক্লু-লেস ও লোমহর্ষক হত্যাকান্ডের মূল রহস্য উদঘাটন করতে সক্ষম হয়। র্যাব-১১ এর একটি চৌকস আভিযানিক দল কর্তৃক ১৬ আগস্ট রাতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে উক্ত ক্লু-লেস ও লোমহর্ষক হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত প্রধান আসামী গাইবান্ধার মোঃ সাইফুল ইসলাম (৩০) , পঞ্চগড়ের মোঃ শামীম (৪০), মোঃ রনি মিয়া ওরফে টনি (৩০), মোঃ আঃ মান্নান শেখ (২২), মোঃ সুমন (৩৮), মোঃ মামুনুর রশিদ (৩৫), মোঃ হাবিবুল্লাহ (৫২)কে গ্রেফতার করা হয়।
র্যাব-১১ ( নারায়ণগঞ্জ) এর অধিনায়ক তানভীর মাহমুদ পাশা এ তথ্য জানিয়েছে।
র্যাব জানান, গত ১৮ জুলাই রাতে অজ্ঞানপার্টি চক্রের মূলহোতা মোঃ সাইফুল ইসলাম ঢাকার কেরাণীগঞ্জ হতে এবং তার সহযোগী মোঃ রনি মিয়া গাইবান্ধা হতে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গায় অবস্থানরত মোঃ শামীম, মোঃ আঃ মান্নান শেখ, মোঃ সুমন, মোঃ মামুনুর রশিদ ও মোঃ হাবিবুল্লাহসহ ০৯ জনের একটি দল সাইফুলের নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ হয়। উক্ত চক্রের মূলহোতা সাইফুলের একজন অন্যতম সহযোগীসহ আরও ৫ জনের একটি দল নাটোর থেকে ০১টি ট্রাক নিয়ে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা এসে সাইফুলের দলের সাথে মিলিত হয়। ১৯ জুলাই ভোর রাতে নারায়ণগঞ্জ হয়ে কুমিল্লার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায়, তারা ঘটনার দিন দুপুরবেলা কুমিল্লার পদুয়ার বাজার বিশ¡রোড এলাকায় এসে পৌছালেও তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করে। সন্ধ্যার পর উক্ত অজ্ঞানপার্টি চক্রের মূলহোতা সাইফুল নিজে যাত্রীসেজে ঈদে ঘরমুখো সাধারণ যাত্রীদেরকে কম টাকায় পরিবহনের আশ^াস দিয়ে ভিকটিম জাহিদুল ইসলাম (৫০) সহ তার সঙ্গীয় আলম (৫০), আরিফ (৩০), শরীফুল ইসলাম (৫০) , সবুজ (৩০) সহ মোট ০৫ জন যাত্রীকে সু-কৌশলে তাদের ট্রাকে উঠিয়ে নাটোরের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা উল্লিখিত যাত্রীদের নিয়ে কিছুদূর আসার পরে পথিমধ্যে তাদের দেখিয়ে শুকনো খাবার ও কোমল পানীয় ক্রয় করে। পরবর্তীতে তারা ট্রাকের সামনে পূর্ব থেকেই রাখা ঘুমের ঔষধ মিশ্রিত অনুরুপ শুকনো খাবার ও কোমল পানীয় সু-কৌশলে পরিবর্তন করে ট্রাক চলাকালীন সময়ে ভিকটিম জাহিদুল ইসলামসহ ০৪ জন যাত্রীকে খাইয়ে অজ্ঞান করে তাদের কাছে থাকা সবকিছু লুট করে নেয়। একজন যাত্রী উক্ত ঘুমের ঔষধ মিশ্রিত শুকনো খাবার ও কোমল পানীয় না খাওয়ায় তাকে বেধড়ক মারধর করে। পরবর্তীতে উক্ত অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা কুমিল্লার দাউদকান্দি ব্রীজ পার হয়ে প্রথমে ০৩ জন যাত্রীকে অজ্ঞান অবস্থায় রাস্তার পাশে ফেলে দেয়। তারপর কিছুদূর আসার পর অজ্ঞান না হওয়া যাত্রীকে রাস্তার পাশে ফেলে দেয়। সবশেষে রূপগঞ্জ থানাধীন টেংরারটেক সাকিনস্থ এশিয়ান হাইওয়ে রোডের পশ্চিম পাশের্¡ ঝোপঝাড়ের মধ্যে ভিকটিম জাহিদুল ইসলামকে গড়িয়ে ফেলে দেয়। ঘুমের ঔষধ মিশ্রিত শুকনো খাবার ও কোমল পানীয় খেয়ে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া ভিকটিম জাহিদুল ইসলাম এর নিকট টাকা পয়সা কম থাকায় সাইফুলের নেতৃত্বে আসামীরা ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে উপুর্যপুরি কিল ঘুষি ও প্রচন্ড মারধর করে। ঔষধের বিষাক্ত প্রভাব এবং প্রচন্ড মারধর করার ফলে ভিকটিম জাহিদুল ইসলামের মৃত্যু হয় বলে ধারনা করা হয়।
অজ্ঞান পার্টি চক্রটি দীর্ঘদিন যাবৎ (প্রায় ১০ থেকে ১২ বছর) ঢাকাসহ সারাদেশব্যাপী বিভিন্ন জায়গায় কখনও এককভাবে আবার কখনও সংঘবদ্ধ হয়ে খাবারের সাথে ঘুমের ঔষধ মেশানোসহ বিভিন্নভাবে যাত্রীদের অজ্ঞান করে টাকা, মূল্যবান সামগ্রীসহ যাত্রীদের সর্বস্ব হাতিয়ে নিয়ে আসছিল। গ্রেফতারকৃত উক্ত চক্রের মূলহোতা মোঃ সাইফুল ইসলামসহ তার সহযোগী অন্যান্য আসামীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ সংঘটনের দায়ে বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে বলে জানা যায় যা ক্রাইম ডাটাবেজ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম বিশ্লেষণ করে সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, উক্ত অজ্ঞানপার্টি চক্রের মূলহোতা মোঃ সাইফুল ইসলামের নামে চেতনানাশক ঔষধ খাইয়ে চুরি করার অপরাধে গত ২০১৬ সালে ২৯ নভেম্বর তারিখে গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা থানায় ০১টি, ২০১৯ সালে একই থানায় জুয়া আইনে ০১টি এবং ২০১৯ সালের ০৩ এপ্রিল তারিখে বগুড়া সদর থানায় চেতনানাশক ঔষধ খাইয়ে চুরি করার অপরাধে ০১টি সহ মোট ০৩টি মামলা রয়েছে। সে ২০১৬ সালে গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা থানায় রুজুকৃত মামলায় গ্রেফতার হয়ে ০৩ মাস ও ২০১৯ সালে একই থানায় রুজুকৃত মামলায় গ্রেফতার হয়ে ১৫ দিন কারা ভোগ করে। আসামী মোঃ রনি মিয়া @ টনি এর বিরুদ্ধে ২০১৫ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ থানায় নেশা জাতীয় দ্রব্য সেবন করিয়ে অটোভ্যান চুরি করার চেষ্টার অপরাধে ও ২০১৮ সালের ২৬ অক্টোবর গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা থানায় প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ করার অপরাধে ০২টি মামলা রয়েছে। উক্ত ২টি মামলায় গ্রেফতার হয়ে সে সর্বমোট ০৩ বছর কারাভোগ করে। আসামী মোঃ আঃ মান্নান শেখ এর বিরূদ্ধে ২০২০ সালে সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া থানায় চুরি করার অপরাধে ০১টি মামলা রয়েছে। উক্ত মামলার প্রেক্ষিতে ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে গ্রেফতার হয়ে সে ০৫ দিন কারাভোগ করে।
আসামী মোঃ মামুনুর রশিদ এর বিরূদ্ধে ২০০৬ সালে চুয়াডাঙ্গা জেলার জিআরপি থানায় ০১টি, ২০০৮ সালে ০৭ সেপ্টেম্বর নাটোরের লালপুর ও বড়াইগ্রাম থানায় নেশা জাতীয় দ্রব্য সেবন করিয়ে চুরি করার অপরাধে ০২টি ও ২০২১ সালের ১১ জানুয়ারি নাটোর সদর থানায় একই অপরাধ সংঘটনের দায়ে ০১টি সহ মোট ০৪টি মামলা রয়েছে। উক্ত আসামী ২০০৬ সালে চুয়াডাঙ্গা জেলার জিআরপি থানার মামলায় সাড়ে ১১ মাস, ২০০৮ সালের পৃথক ০২টি মামলায় আড়াই বছর এবং ২০২১ সালের অপর ০১টি মামলায় গ্রেফতার হয়ে ১৪ দিন কারাভোগ করে। গ্রেফতারকৃত আসামী মোঃ মামুনুর রশিদ দীর্ঘ ২০ বছর যাবৎ অজ্ঞানপার্টি চক্রের সক্রিয় সদস্য হিসেবে কাজ করে আসছে বলে জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করে। উল্লেখ্য যে, একই দিনে উক্ত চক্রটি গাজীপুর চৌরাস্তা এলাকায় ০৩ জন ব্যক্তিকে ঘুমের ঔষধ মিশ্রিত কোমল পানীয় মিরিন্ডা খাইয়ে অজ্ঞান করে ১৩ হাজার টাকা এবং ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে এক গরু ব্যবসায়ীকে একই কায়দায় অজ্ঞান করে ১ লক্ষ ৩৪ হাজার লুট করে নেয় বলে স্বীকার করে। গ্রেফতারকৃত আসামীদের সংশ্লিষ্ট মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট হস্তান্তর কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন
যোগাযোগের ঠিকানাঃ মোল্লা ব্রিজ, যাত্রাবাড়ী, ঢাকা-১২০৪। মোবাইলঃ ০১৯১৮-৪০৪৭৬০, বিজ্ঞাপনঃ ০১৭৩৩-৩৬১১৪৮