মো.ইমরান হোসেন,
কালিয়াকৈর (গাজীপুর) প্রতিনিধি।।
গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বিনিরাইল গ্রমের আড়াইশো বছরের ঐতিহ্য প্রতি বছরের মতো এবছর পৌষ মাসের শেষের দিন মাছের মেলা ব্যাপক উৎসাহ -উদ্দীপনার সাথে পালিত হয়েছে। প্রতি বছর পৌষ-সংক্রান্তিতে অনুষ্ঠিত হয় এ মেলা । মাছের মেলাকে ঘিরে আশে পাশের কয়েক জেলায় শুক্রবার দিনভর চলে আনন্দ-উৎসব। মূলত এটা জামাই মেলা হিসেবে ব্যাপক পরিচিত | কিন্তু সবাই এটাকে বলে মাছের মেলা। আর এই দিনটিকে ঘিরেই এখানে দিনব্যাপী চলে আনন্দ-উৎসব। এ দিনটির জন্য সারাটি বছর অপেক্ষায় থাকেন স্থানীয়রা। এই মেলায় আছে একের ভেতর দুই। কারণ এটা মাছের মেলা হলেও, এখানে চলে এলাকার জামাইয়ের মাছসহ সবকিছু বড় কেনার প্রতিযোগীতা। বিনিরাইল এবং এর আশপাশের গ্রামে যারা বিয়ে করেছেন, সে সমস্ত জামাইরা হচ্ছে ওই মেলার মূল ক্রেতা ও দর্শণার্থী |
জানা যায় ,একটা মাছকে ঘিরে শুক্রবার ক্রেতা জামাইদের জটলা লেগে আছে। বিশাল আকৃতির এ মাছের নাম বাঘা আইড়। বিক্রেতা ৪০ কেজি ওজনের এ মাছের দাম হেঁকেছেন ৬৫ হাজার টাকা। ক্রেতাদের মধ্যে স্থানীয় কাপাইশ এলাকার জামাই মোহাম্মদ হোসেন আলী মাছটির দাম সর্বোচ্চ ৪৫ হাজার টাকা বলছেন।,কিন্তু বিক্রেতা আরো বেশি দাম পাবার আশায় মাছটি ছাড়ছেন না। চলছে দর কষাকষি। যত না ক্রেতা তার চেয়ে অনেক বেশি উৎসুক জনতা ভিড় জমিয়েছেন মাছটি দেখার জন্য। পৌষ মাসের শেষ দিন শুক্রবার কালীগঞ্জ উপজেলার বক্তারপুর ইউনিয়নের ত্রিমোহনার বিনিরাইল গ্রামে ঐতিহ্যবাহী আড়াইশ বছরের পুরনো মাছের মেলায় দেখা গেছে এই দৃশ্য।
এছাড়া এই মেলাকে ঘিরে এলাকার শ্বশুরদের মধ্যেও চলে এক নীরব প্রতিযোগীতা। আর এই প্রতিযোগীতাটি হচ্ছে কোন জামাই সবচেয়ে বড় মাছটি ক্রয় করে শ্বশুরবাড়ীতে নিয়ে যেতে পারে। আবার শ্বশুররাও চান কোন শ্বশুর সবচেয়ে বড় মাছটি ক্রয় করে জামাই আপ্যায়ন করতে পারে। বিনিরাইলের মাছের মেলা যেন জামাই-শ্বশুরের বড় মাছ কেনার প্রতিযোগীতার মাঠ। গাজীপুর জেলার সর্বত্র টাঙ্গাইল, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, ভৈরব, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকজন কেবল এই মেলা উপলক্ষেই কালীগঞ্জে এসেছেন। এর বাইরে থেকেও অনেকে এসেছেন উপজেলার সর্ববৃহৎ এই মাছের মেলায়। প্রতি বছর পৌষ-সংক্রান্তিতে অনুষ্ঠিত হয় এ মেলা। এবারের মেলায় প্রায় ৩ শতাধিক মাছ ব্যবসায়ী বাহারি মাছের পসরা সাজিয়ে বসেছেন। মেলায় মাছ ছাড়াও আসবাবপত্র, খেলনা, মিষ্টি ইত্যাদির পসরাও বসেছে। মাছের মেলায় সামুদ্রিক চিতল, বাঘাড়, আইড়, বোয়াল, কালী বাউশ, পাবদা, গুলসা, গলদা চিংড়ি, বাইম, কাইকলা, রূপচাঁদা মাছের পাশাপাশি স্থান পেয়েছে নানা রকমের দেশী মাছও।
বিনিরাইলের মাছের মেলার আয়োজক কমিটির সভাপতি ও ইউপি সদস্য কিশোর আকন্দ জানান, এই মেলাটি প্রথম অনুষ্ঠিত হতো খুবই ক্ষুদ্র পরিসরে এটি অগ্রহায়ণের ধান কাটা শেষে পৌষ-সংক্রান্তি ও নবান্ন উৎসবে আয়োজন করা হতো। প্রায় ২৫০ বছর যাবৎ মেলাটি আয়োজন হয়ে আসছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ মেলাটি একটি সর্বজনীন উৎসবে রূপ নিয়েছে। ব্রিটিশ শাসনামল থেকে বিনিরাইলের মাছের মেলা এখন ঐতিহ্যে রূপ নিয়েছে। এ মেলা কালীগঞ্জের সবচেয়ে বড় মাছের মেলা হিসেবে স্বীকৃত। এলাকার জামাইরা বলেন, শ্বশুরবাড়ীতে মাছ নিয়ে যাওয়া বলে কথা। তাই এলাকার সকল জামাইদের নজর বিনিরাইলের মাছের মেলার বড় মাছটার দিকেই। তাই স্থানীয় বড় মাছ ব্যবসায়ীরা সপ্তাহব্যাপী বড় বড় মাছ সংগ্রহ করে থাকেন। সেই অনুযায়ী মাছের দামও হাঁকানো হয়।
বিনিরাইলের মাছের মেলা নিয়ে কথা হয় মেলা সংলগ্ন জামালপুর ইউনিয়নের কাপাইস গ্রামের জামাই মো. ফরহাদ হোসেন বলেন, শ্বশুরবাড়ীতে মাছ নিয়ে যাওয়া বলে কথা। তাই এলাকার সকল জামাইদের নজর বিনিরাইলের মাছের মেলার বড় মাছটার দিকেই । তিনি জানান, এবার সাড়ে ১৭ হাজার টাকার চিতল, বোয়াল, আইড়সহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ কিনেছেন শশুরবাড়ীতে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলা থেকে মেলায় আসা মাছ ব্যবসায়ী বিজয় কুমার দাস জানান, তিনি প্রায় ২০ বছর ধরে এই মেলায় দোকান করেন। বিনিরাইলের পাশেই চুপাইর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে বসে তিন দিনব্যাপী মাছের এ মেলা। ইতিহাস ঐতিহ্যের কারণে বিনিরাইলে কেনার চেয়ে দেখতে আসা মানুষের ভীড় এখন বেশী। তাছাড়া স্থানীয় মানুষের সাথে ভালো সম্পর্ক স্থাপন হওয়াতে প্রতি বছর এ মেলায় যোগদেন। এখানে বেচা-কেনাকে মুখ্য মনে করেন না বলে জানান তিনি। এবার মেলায় প্রচুর দেশি রুই, কাতল, বোয়াল, আইড়, বাঘাইর, চিতল, কালবাউশ ও রিটা মাছের সমাগম হয়েছে। টাঙ্গাইল থেকে ঘুরতে আসা মো. আজগর আলী বলেন, ব্যবস্হাপনায় উন্নত ও ব্যাপক প্রচার হলে ঐতিহাসিক মাছের মেলায় জনসমাগম আরো বৃদ্ধি পাবে।
যোগাযোগের ঠিকানাঃ মোল্লা ব্রিজ, যাত্রাবাড়ী, ঢাকা-১২০৪। মোবাইলঃ ০১৯১৮-৪০৪৭৬০, বিজ্ঞাপনঃ ০১৭৩৩-৩৬১১৪৮