মনির হোসেন বরিশাল ব্যুরো :
ডিজিটাল যুগে প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে কীটনাশকমুক্ত ধান চাষে ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছেন বরিশালের কৃষকরা। ফলে মাত্র একবছরের ব্যবধানে কৃষকের মুখে এখন হাসি ফুটে উঠেছে। পূর্ব পুরুষের এনালগ যুগের কীটনাশক ব্যবহাররোধ করে প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মাধ্যমে কৃষকদের ডিজিটাল যুগে ফিরিয়ে এনেছেন ব্রির ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা কীটতত্ত্ববিদ মনিরুজ্জামান কবির।
গতকাল বুধবার সকালে তিনি (মনিরুজ্জামান কবির) বলেন, বাংলাদেশ ক্রপ প্রটেকশন এসোসিয়েশনের তথ্যমতে ষাটের দশকে সবুজ বিপ্লবের পর ধান চাষে কীটনাশকের ব্যবহার আশংকাজনহারে বেড়ে যায়। সর্বপ্রথম ১৯৫৬ সালে ফসলের পোকামাকড় দমনে তিন টন কীটনাশক আমদানি করা হয়। ২০২০ সালে বাংলাদেশে কীটনাশকের আমদানির পরিমাণ ছিল ৩৭ হাজার ৫৬৩ মেট্টিক টন। ফলে ক্ষতিকর পোকামাকড়ের আক্রমণে আউশ মৌসুমে ২৪%, আমনে ১৮% এবং বোরোতে ১৩% ধানের ফলন কমে যায়। ক্ষতিকর পোকামাকড়ের হাত থেকে ধান ফসলকে রক্ষার জন্য কৃষকরা জমিতে নির্বিচারে কীটনাশক প্রয়োগ করেন। যেকারণে প্রতি মৌসুমে কৃষকরা মাজরা পোকা, পাতামোড়ানো পোকা, পামরি পোকা, বাদামি গাছফড়িং ও গান্ধিপোকা দমনের জন্য গড়ে তিন থেকে চারবার ধানের জমিতে কীটনাশক প্রয়োগ করেন। তিনি আরও বলেন, কীটনাশক প্রয়োগে একদিকে যেমন মাটি, পানি ও বায়ু বিষাক্ত হচ্ছে। অন্যদিকে কৃষকদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বৃদ্ধির পাশাপাশি উৎপাদন খরচও বেড়ে যাচ্ছে।
মানা হচ্ছেনা স্বাস্থ্যবিধি \ মুখে মাস্ক, গায়ে এ্যাপ্রোন, চোখে চশমা ও হাতে দস্তানা পরে কীটনাশক প্রয়োগ করার নিয়ম থাকলেও কৃষকরা মাঠপর্যায়ে খালি গায়েই কীটনাশক স্প্রে করছেন। এতে করে কৃষকরা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পরছেন। ত্বকের ক্ষত, জ্বালাপোড়া, ক্যানসারসহ কীটনাশক নাক ও মুখ দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে কিডনী ড্যামেশ পর্যন্ত করে দিচ্ছে। তাছাড়া শরীরের অন্যান্য জটিল রোগ তৈরি করছে। কীটনাশক কৃষকদের অন্ধত্বেরও কারণ। কীটনাশক দীর্ঘমেয়াদী মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
কীটনাশক প্রয়োগের ক্ষেত্রে কৃষকদের পরামর্শ দিয়ে ব্রির ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা কীটতত্ত্ববিদ মনিরুজ্জামান কবির বলেন, খালি গায়ে কীটনাশক স্প্রে করা যাবেনা। এতে চরম স্বাস্থঝুঁকি রয়েছে। কীটনাশক স্প্রে করার সময় কৃষকদের অব্যশই শরীরে পুরাতন কাপড় পরিধান, নাক-মুখে পুরাতন গামছা পেছিয়ে ও চোখে চশমা ব্যবহার করতে হবে। এতে করে স্বাস্থ্যঝুকি অনেকটা কম হবে।
প্রযুক্তির বৈশিষ্ট্য \ জমিতে কীটনাশক ব্যবহার না করে বিনা খরচেই পার্চিং করা যায়। স্বল্প খরচে হাতজাল তৈরি করা যায়। কীটনাশকের বিষক্রিয়া থেকে পরিবেশ বিশেষত পানি ও বায়ু দূষণমুক্ত থাকে। কৃষক নিজেই হাতজাল ব্যবহার করে জমিতে পোকার আক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়ে ক্ষতিকর পোকামাকড়ের উপস্থিতি সনাক্ত ও ধ্বংস করতে পারবে। এতে করে জমিতে বন্ধুপোকার সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। যেগুলো পরবতর্ীতে ক্ষতিকর পোকামাকড়ের ডিম ও লার্ভা খেয়ে দমন করবে। ফলে কীটনাশকের ব্যবহার ৫০ থেকে ১০০% পর্যন্ত কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। পাশাপাশি বিঘা প্রতি ধান উৎপাদন খরচ এক হাজার থেকে ১৫শ’ টাকা পর্যন্ত সাশ্রয় হবে। কীটনাশকের ব্যবহার কমলে কৃষক ও ভোক্তা দীর্ঘমেয়াদী বিষক্রিয়া থেকেও বাঁচবে।
প্রযুক্তি উদ্ভাবনের নেপথ্যে \ বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) বরিশাল মূলত দুইটি খামার নিয়ে গঠিত। চরবদনা খামার ৭৫ একর, সাগরদী খামার ২০ একর। ২০১৯ সালের বোরো মৌসুমে দুই খামারেই মাজরা পোকার প্রচন্ড আক্রমণ দেখা দেয়। তিনবার কীটনাশক স্প্রে করেও পোকা দমন করা যাচ্ছিলো না। অতঃপর কীটত্ত্ববিদ মনিরুজ্জামান কবির, মাজরা পোকায় খাওয়া সাদা শীষ (মাজরা পোকায় নষ্ট করা) সংগ্রহ করে গাছের কান্ডের ভিতর কালো মাথার মাজরা পোকার উপস্থিতি দেখতে পান। পরবর্তীতে কারটাপ গ্রুপের কীটনাশক স্প্রে করে মাজরা পোকা দমন করা হয়। একইবছরের আমন মৌসুমের ব্রি বরিশালের সকল ধানের জমিতে চারা রোপণ থেকে গাছে ফুল আসার আগ পর্যন্ত হাতজাল দিয়ে মাজরা পোকা ধরে মেড়ে ফেলা হয়। সেইসাথে হাতজালে কোন উপকারী পোকা আসলে সেটি পুনরায় ধানের জমিতে ছেড়ে দেওয়া হয়।
ক্ষতিকর পোকার সিংহভাগই বাদামি রঙের আর উপকারি পোকাগুলো রঙ্গিন হয়ে থাকে। হাতজাল দিয়ে হেটে হেটে মাজরা পোকা ধরার সময় ধান গাছের পাতা থেকে ডিমের গাদা সংগ্রহ করে ধ্বংস করা হতো। এক্ষেত্রে চরবদনা খামারে দুইজন ও সাগরদী খামারে একজনকে হাতেকলমে প্রশিক্ষণ প্রদান করেন এ কীটতত্ববিদ।
এ পদ্ধতিতে ২০১৯ এর আমন, ২০২০ সালের আউশ, আমন ও বোরো এবং ২০২১ সালের আউশ, আমন ও বোরো মৌসুমে কোন প্রকার কীটনাশক প্রয়োগ ছাড়াই ধান উৎপাদিত হয়েছে। ব্রি বরিশালের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, ধানের জমিতে ২৬৬ প্রজাতির ক্ষতিকর পোকা ও ৩৪৬ প্রজাতির উপকারী পোকা রয়েছে। ধানের চারা রোপনের শুরুতেই কীটনাশক প্রয়োগ করলে উপকারী ও ক্ষতিকর উভয় পোকাই মারা যায়। পরবতর্ীতে ক্ষতিকর পোকা দমন করা যায়না। তাই চারা রোপণের পর থেকে ফুলআসা পর্যন্ত হাতজাল দিয়ে মাজরা পোকা ও তার ডিম সংগ্রহ করে ধ্বংস করে ফেললে কীটনাশক প্রয়োগ করার দরকার পরেনা।
তিনি আরও বলেন, ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত মাজরা পোকা গাছের পাতায় বসে থাকে। তখন হাতজাল দিয়ে হেটে হেটে পোকটি সহজেই ধরা যায়। সেইসাথে ধানের জমিতে চারা রোপণের পরপরই ডালপালা পুথে পোকাখেকো পাখি বসার ব্যবস্থা (পার্চিং) করতে হবে।
মাঠ পর্যায়ে সাফল্য \ ব্রি বরিশালে প্রযুক্তিটি সফল হবার পর কৃষি সম্পসারণ অধিদপ্তরের সহযোগিতায় বরিশাল বিভাগের বরগুনা জেলার আমতলী উপজেলার উওর রাওঘা গ্রামের রাওঘা ব্লকে ১০ একর জমিতে আমন মৌসুমে ধানের প্রদর্শনী প্লট দেওয়া হয়। প্রদর্শনীতে কৃষকদের ব্রি ধান ৭৬ এর বীজ দেওয়ার পাশাপাশি হাতজাল বিতরণ করা হয়। প্রদর্শনীতে কৃষকদের হাতজাল দিয়ে ক্ষতিকর পোকা ধরে ধ্বংস করা ও উপকারী পোকা (রঙ্গিন পোকা) আবার জমিতে ছেড়ে দেওয়ার পদ্ধতি হাতে কলমে শিখিয়ে দেওয়া হয়। ফলশ্রুতিতে গত ২৫ নবেম্বর উক্ত প্রদর্শনীটির মাঠ দিবসে প্রায় দেড় শতাধিক কৃষক বিষমুক্ত ধান চাষের মাঠ দিবসে উপস্থিত হন।
ব্রির কীটতত্ত্ব বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শেখ শামিউল হক বলেন, চারা রোপনের পর মাজরা পোকা কিছু গাছের কান্ড কেটে দিলেও ফলনের কোন ক্ষতি হয়না। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, পরবর্তীতে যে কুশিগুলো জন্মে সেগুলো থেকে ভাল ফলন পাওয়া যায়। কিন্তু কৃষকরা ১/২টি পোকা দেখলেই কীটনাশক প্রয়োগ শুরু করেন। ধানের জমি চারা রোপণের প্রথম ৩০ থেকে ৪০দিন কীটনাশক মুক্ত রাখতে হবে।
বিষমুক্ত ধান চাষের এ প্রযুক্তির ব্যাপারে ব্রি বরিশালের প্রধান ও মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আলমগীর হোসেন জানান, পর্যায়ক্রমে এ পদ্ধতি সম্পর্কে বিভাগের ছয় জেলার কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হবে। তিনি আরও জানান, বিষমুক্ত ধান চাষের এ প্রযুক্তি ব্যবহার করলে একদিকে কৃষকরা যেমন আর্থিকভাবে লাভবান হবেন, তেমনি কৃষকদের স্বাস্থ্য ঝুকিও কমে যাবে।
যোগাযোগের ঠিকানাঃ মোল্লা ব্রিজ, যাত্রাবাড়ী, ঢাকা-১২০৪। মোবাইলঃ ০১৯১৮-৪০৪৭৬০, বিজ্ঞাপনঃ ০১৭৩৩-৩৬১১৪৮