
কক্সবাজার অফিস:
কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টে অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসনের কড়াকড়ি অবস্থান। দীর্ঘদিন ধরে সৈকতের বালিয়াড়ি দখল করে গড়ে তোলা দোকানপাট ও স্থাপনা ভেঙে দেওয়া হয়েছে। রবিবার (১২ অক্টোবর) সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত টানা অভিযানে সৈকতের সৌন্দর্য নষ্ট করা এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে প্রশাসন।
সকাল ১১টা থেকে শুরু হয়ে দুপুর ৩টা পর্যন্ত পরিচালিত এ অভিযানে অংশ নেয় জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী, র্যাব, ট্যুরিস্ট পুলিশ, জেলা পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। উচ্ছেদে ব্যবহৃত হয় একটি ভারী স্কেভেটর। প্রশাসনের এই অভিযানে মুহূর্তেই বালিয়াড়ি কাঁপে, ভেঙে পড়ে টিনশেড দোকান, কাঠের টংঘর ও অস্থায়ী অবকাঠামো।
এর আগের দিন শনিবার দুপুরে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও অংশীজনদের নিয়ে এক জরুরি বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়- সৈকতের নতুন স্থাপনাগুলো ১১ অক্টোবর রাতের মধ্যে এবং পুরোনো স্থাপনাগুলো ১৬ অক্টোবরের মধ্যে সরিয়ে ফেলতে হবে। কিন্তু নির্দেশনা অমান্য করে দখলদাররা রাতে আবার দোকান চালু রাখে। ফলে রবিবার সকালে মাঠে নামে প্রশাসনের বিশেষ টিম।
জেলা প্রশাসক মোঃ আঃ মান্নান বলেন, ‘বন, পরিবেশ ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে সৈকতের পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষায় আমরা কঠোর অবস্থানে গেছি। কক্সবাজারের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এক ইঞ্চি দখলও আর সহ্য করা হবে না’।
তিনি আরও বলেন, ‘যেখানে জোয়ার-ভাটার ঢেউ আছড়ে পড়ে, সেখানে দোকান গড়ে তোলার কোনো অধিকার কারও নেই। এটি শুধু আইনবিরোধী নয়, প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণও’।
ট্যুরিস্ট পুলিশের কক্সবাজার অঞ্চলের অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক আপেল মাহমুদ জানান, ‘দুপুর ২টার মধ্যে দখলকারীদের নিজ উদ্যোগে স্থাপনা সরাতে বলা হয়েছিল। কিন্তু কেউ তা মানেনি। ফলে প্রশাসন বাধ্য হয়ে অভিযান চালিয়েছে। অন্তত ৫০টি দোকানপাট ও স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে’।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. শাহিদুল আলম বলেন, ‘স্থাপনা সরাতে একাধিকবার সময় ও সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। তারা তা অমান্য করায় কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এই অভিযান একদিনের নয়- ধারাবাহিকভাবে চলবে’।
কক্সবাজার
সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিলুফা ইয়াসমিন চৌধুরী জানান, ‘দখলদারদের আমরা বারবার লিখিত ও মৌখিকভাবে সতর্ক করেছি। পরিবেশ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী এই স্থাপনাগুলো সম্পূর্ণ অবৈধ’।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়,
সরকার ১৯৯৯ সালে কক্সবাজারের নাজিরারটেক থেকে টেকনাফ পর্যন্ত ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্রসৈকতকে ‘প্রতিবেশগতভাবে সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ)’ হিসেবে ঘোষণা করে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে স্পষ্টভাবে বলা আছে- জোয়ার-ভাটার অঞ্চল থেকে ৩০০ মিটারের ভেতরে কোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণ, উন্নয়ন বা ব্যবসায়িক কার্যক্রম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু বছরের পর বছর প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে সৈকতের বালিয়াড়ি, ঝাউবন ও উপকূলজুড়ে গড়ে ওঠে টংঘর, দোকান, হোটেল, এমনকি রেস্টুরেন্টও। এসব দখলদারির কারণে সৈকতের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেমন বিনষ্ট হচ্ছে, তেমনি হুমকির মুখে পড়ছে সামুদ্রিক প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য।
এর আগে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরসহ একাধিকবার কক্সবাজার সৈকতে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হলেও কিছুদিন পরই দখলদাররা ফিরে আসে। বিশেষ করে বিদায়ী জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিনের বদলির পর সুগন্ধা পয়েন্টে বালিয়াড়ি দখলের প্রবণতা বাড়তে থাকে। দিনে দিনে গজিয়ে ওঠে টংঘর, রেস্টুরেন্ট, চা–কফির দোকান, কাঠের কুটির। স্থানীয়রা জানান, রাতে সৈকতের বিভিন্ন স্থানে গোপনে ট্রলি ভরে আনা হয় টিন, কাঠ, বাঁশ, বালু। সকালে দেখা যায় নতুন দোকান বসে গেছে। এতে সৈকতের প্রাকৃতিক দৃশ্য নষ্ট হচ্ছে, পর্যটকদের চলাচলেও তৈরি হচ্ছে বাধা।
সেভ দ্য কক্সবাজার ও অন্যান্য পরিবেশ সংগঠনগুলোর অভিযোগ, প্রশাসনের অনিয়মিত নজরদারি ও কিছু প্রভাবশালী মহলের আশ্রয়ে দখলদারি ফের মাথাচাড়া দেয়।
পরিবেশ ও জলবায়ু সুরক্ষা বিষয়ক নাগরিক সংগঠন ‘সেভ দ্য কক্সবাজার’ এর চেয়ারম্যান সাংবাদিক তৌহিদ বেলাল বলেন, ‘সৈকতের বালিয়াড়ি দখল মানেই উপকূলের মৃত্যু। এরা শুধু দোকান বসাচ্ছে না, প্রকৃতির বুকে ছুরি চালাচ্ছে’।
জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, সৈকতের সৌন্দর্য ও পরিবেশ সংরক্ষণে নিয়মিত উচ্ছেদ অভিযান চলবে। অবৈধভাবে পুনরায় স্থাপনা নির্মাণ করলে দায়ীদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জেলা প্রশাসক মোঃ আঃ মান্নান শেষবারের মতো হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন, ‘কক্সবাজার সৈকত রাষ্ট্রের সম্পদ। দখলদারদের কোনো ছাড় নেই। সৈকতের প্রতি এক ইঞ্চি অবৈধ দখল মানেই আইন অমান্য, প্রকৃতির প্রতি অপরাধ’।
কক্সবাজার সৈকতের বালিয়াড়ি দখলমুক্ত করতে জেলা প্রশাসনের এই ব্যাপক অভিযান শুধু উচ্ছেদ নয়- এটি সৈকতের অস্তিত্ব রক্ষার যুদ্ধ। প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপে আশা জাগছে, হয়তো এবার সত্যিই সমুদ্রের ঢেউ ফিরে পাবে তার প্রাকৃতিক স্বাধীনতা।