
মনির হোসেন,বরিশাল ব্যুরো॥
‘বরিশালে আমড়া’র খ্যাতি বিশ্বজুড়ে। দক্ষিণাঞ্চলের মাটি ও পানি আমড়া চাষের জন্য বেশ উপযোগী। বিশেষ করে বরিশালের ঝালকাঠী-পিরোজপুরে সুস্বাদু আমড়ার ফলন হয় সবচেয়ে বেশি। বলা চলে সারা দেশের আমড়ার চাহিদার ৬০-৭০ ভাগ মেটায় এ অঞ্চলের চাষিরা। গেল কয়েক বছরে বাম্পার ফলনও হয়েছে। সুস্বাদু আর সুখ্যাতির কারণে কৃষকরা দামও পেয়েছেন বেশ।ভালো টাকা আয়ের সুযোগ থাকায় পিরোজপুরে আমড়া চাষির সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে। তবে গৃহস্থদের কাছ থেকে কেনা বস্তা প্রতি আট-নয়শ’ টাকার (প্রতি বস্তায় আট থেকে সাড়ে আটশ’) আমড়া হাত বদল হয়ে ঢাকায় এসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে ২২০০-২৫০০ টাকা ছাড়ায়। ইতোমধ্যে পিরোজপুরে আমড়া একটি অর্থকারী ফল হিসেবে জায়গা করে একন বিশ্বজুড়ে। এটি চাষ করে জেলার বিভিন্ন উপজেলার চাষিরা বেশ ভালো আয় করছেন। এমনকি স্থানীয়দের চাহিদা মিটিয়ে বর্তমানে ইউরোপসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হচ্ছে।জেলার বিভিন্ন উপজেলার স্থানীয় বাজারে পাইকারদের মাধ্যমে এসব আমড়া বিক্রি করে বাগানের মালিকরা কোটি কোটি টাকা আয় করছেন। তবে মধ্যস্বত্বভোগীদের অধিক মুনাফার কারণে আমড়া চাষিরা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। গৃহস্থদের কাছ থেকে এক বস্তা আমড়া আট-নয়শ’ টাকায় কিনে তা জেলার বাজারে প্রায় ১৪-১৫শ’ টাকায় বিক্রি করছে ব্যাপারীরা। আর সেই আমড়া ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার বাজারে পাইকারী প্রতিবস্তা ২২-২৫শ’ টাকায় বিক্রি হয়।জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আবু হেনা মো. জাফর জানান, চলতি মৌসুমে গত দু’তিন বছরের তুলনায় আমড়ার ফলন অনেক ভালো হয়েছে। কৃষকরা তাদের চাহিদা মতো দামও পাচ্ছেন। জেলার কাউখালী, নাজিরপুর ও নেছারাবাদে এর চাষ বেশি হয়েছে। প্রায় সব বাড়িতেই অন্তত দু’তিনটি করে আমড়া গাছ আছে। এসব এলাকার রাস্তার পাশে, বাড়ির আঙিনায় আমড়া গাছ লাগানো প্রতিটি মানুষের নেশায় পরিণত হয়েছে।
এ এলাকার মাটি ও আবহাওয়া আমড়া চাষের জন্য খুবই উপযোগী। লাভজনক এ মৌসুমী ফল আমড়া গাছে রোগ বালাই খুবই কম। আমড়া গাছ রোপণের দু’বছর পরই তা ফল দেয় এবং কমপক্ষে ১০/১২ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে।এসব এলাকার আমড়া কেনা-বেচার জন্য রয়েছে একদল ব্যাপারী। তারা চৈত্র-বৈশাখ মাসে গৃহস্থদের অগ্রিম টাকা দিয়ে আমড়ার গাছ কিনেন। ওই ক্রেতারা স্থানীয় পাইকারদের কাছে এসব আমড়া বিক্রি করেন। পাইকাররা তা বস্তাবন্দি করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠায়। এসব পাইকারদের স্থানীয় ভাষায় মহাজন বলে। মহাজনরা গ্রাম থেকে গৃহস্থদের কাছ থেকে আমড়া কেনার জন্য স্থানীয় ক্রেতাদের অগ্রিম টাকা দিয়ে থাকেন। একে স্থানীয় ভাষায় দাদন বলে।শ্রাবণ থেকে কার্তিক- চারমাস পর্যন্ত স্থানীয় ব্যাপারীরা গৃহস্থদের কাছ থেকে আমড়া কিনেন। আবার কেউ কেউ গৃহস্থদের কাছ থেকে কেনা গাছ থেকে এসময়ে পর্যায়ক্রমে আমড়া সংগ্রহ করেন। তারপর সেগুলো বস্তা হিসেবে ব্যাপারীরা জেলার সবচেয়ে বড় আমড়ার মোকাম কাউখালীতে নিয়ে বিক্রি করেন। এরপর সেখান থেকে লঞ্চে করে ঢাকা, চাঁদপুর, মুন্সিগঞ্জ, চট্টগ্রাম, রংপুর, সিলেট, যশোরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়। কৃষি কর্মকর্তা জানান, পিরোজপুর তথা বরিশালের আমড়া এখন দেশের ঐতিহ্য। দেশের চাহিদা মিটিয়ে এখন ভারত, মালয়েশিয়া, নেপাল,ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে তা পাঠানো হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যেও যাচ্ছে নিয়মিত।নাজিরপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা দ্বিগ বিজয় হালদার জানান, এখানে (নাজিরপুর) প্রায় ৭৫ হেক্টর জমিতে আমড়া চাষ হয়। চাষিরা গত দু’তিন বছরের তুলনায় এবার আমড়ার দাম ভালো পেয়েছেন। এ উপজেলার কলারদোয়ানিয়া, দেউলবাড়ি ও মালিখালী ইউনিয়নে আমড়ার চাষ বেশি হচ্ছে। এসব এলাকা নিচু হওয়া সত্ত্বেও চাষিরা তাদের পতিত জমিতে কান্দি কেটে মাটি উঁচু করে আমড়ার চাষ করেছেন।গাছ রোপণের দু’বছর পরই তা ফল দেয় এবং কমপক্ষে ১০/১২ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে। তবে এসব গাছ একটু বেশি বয়স হলে পোকা ধরে। শতাংশ প্রতি তিন-চারটি গাছ লাগালে এর ফলন বেশ ভালো হয়। গত দু’বছর ধানের দাম কম পাওয়ায় এলাকার কৃষকরা আমড়া চাষের দিকে ঝুঁকছেন।নাজিরপুরের আমড়া চাষি আছাদুজ্জামান শিকদার বলেন, ধানের দাম কম পাওয়ায় আমড়া চাষের দিকে ঝুঁকছি। আমড়া চাষ সহজ ও লাভজনক। এবছর প্রায় দুই একর জমিতে লাগানো আমড়া গাছ থেকে প্রায় এক লাখ ৭০ হাজার টাকা পেয়েছি। কিন্তু সমপরিমাণ জমিতে ধানচাষ করলে মাত্র ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকার বেশি পেতাম না।তিনি আরও বলেন, আমড়া গাছের বয়স একটু বেশি হলে তাতে পোকায় ধরলে স্থানীয় উপজেলা কৃষি অফিসের পরামর্শে প্রতিকার করা সম্ভব। তাছাড়া কিছু কিছু গাছে বৈশাখের শুরুতে নতুন গজানো পাতায় লেদাপোকা আক্রমণ করে। এসময় বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক ছিটালে তা দূর হয়।ঝালকাঠি জেলার আমড়া মোকামের ব্যবসায়ী কবির হোসেন বলেন, এ মোকাম থেকে বছরের শ্রাবণ থেকে কার্তিক এই চারমাস দেশের বিভিন্নস্থানে কোটি কোটি টাকার আমড়ার চালান যায়।