
অরবিন্দ রায়
স্টাফ রিপোর্টার।।
গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল জটিল -এক্সিলারী আর্টারী রিপেয়ারিং- এ সফলতা অর্জন করেছে।
প্রতিদিনের ন্যায় বাড়ীর আঙিনার একটি পোল্ট্রি ফার্মের পাশে সমবয়সী ছেলেমেয়েদের সাথে খেলা করছিল সাড়ে তিন বছর বয়সের মোরসালিন। অসাবধানতাবশত পোল্ট্রি ফার্মে ব্যবহার করার জন্য নিয়ে আসা একটি স্টীলের প্লেন শিটের উপর পড়ে যায় সে। মুহুর্তেই ঘটে বিপদ। ডান হাতের বগলের নীচের অংশ প্রচন্ড জখমে কেটে যায় । ফিনকী দিয়ে বের হতে থাকে রক্ত। তা দেখে তার সাথে থাকা হতবিহবল ছেলেমেয়েরা খবর দেয় মোরসালিনের মাকে। দ্রুত ছুটে এসে তার মা মোরশেদা বেগম শরীরের কাপড় দিয়ে ক্ষতস্থানটি বেধে রক্ত আটকাতে চেষ্টা করেন। কিন্ত প্রচন্ড রক্তক্ষরনে ক্রমেই দুর্বল হতে থাকে মোরসালিন। তার বাবা রাসেল ভূইয়া ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা দ্রুত নিয়ে আসে গাজীপুর সদরের শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ততক্ষনে বেজে যায় বিকেল পাঁচটা।
সকালের শিফটের অনেক দক্ষ ডাক্তাররাই চলে যায় তাদের ডিউটি শেষ করে। কিন্ত তখনও হাসপাতালের আবাসিক সার্জন ডাক্তার কৃষ্ণ কুমার দাশ কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন হাসপাতালে। তিনি দেখতে পেলেন- দ্রুত এ রোগীর অপারেশন না করতে পারলে তাকে বাঁচানো অনেকটা কঠিন হয়ে যাবে। কারন ততক্ষনে মোরসালিন অনেকটাই নিস্তেজ হয়ে গিয়েছিল । শরীরের প্রায় ৫০ ভাগ রক্ত চলে গিয়ে সে ক্রমেই জটিল অবস্থার দিকে যাচ্ছিল। কিন্ত তার অপারেশনের জন্য সে ম্যানেজমেন্ট সাপোর্ট দরকার- তা সে মুহুর্তে হাসপাতালে ছিল না। প্রস্তত ছিল না অপারেশন থিয়েটার, প্রয়োজনীয় সুতা, ক্ল্যাম কিছুই নেই এখানে। একদিকে সক্ষমতার অভাব- অন্যদিকে একজন মুমুর্ষ রোগী। ত্বরিত সিদ্ধান্ত নিলেন ডাঃ কৃষ্ণ। এ জটিল রোগীর অপারেশন করবেন তিনি।
দ্রুত সব কিছু ম্যানেজ করলেন আশেপাশের বিভিন্ন জায়গা থেকে । খবর দিলেন শিশু এনেসথেশিয়ার ডাক্তারকে। প্রস্তুত করলেন আইসিইউ। শুরু করলেন অপারেশন। অবশেষে প্রায় ৩ ঘন্টা পর সফল হলেন তিনি। যুদ্ধ জয়ের মত বিজয়ের হাসি ডাক্তারসহ সকল স্টাফদের মুখে। কারন, ঢাকার একমাত্র একটি সরকারী ইনস্টিটিউট ছাড়া এ ধরনের জটিল অপারেশন আর কোথাও হয় না। কিন্ত অসাধারন এই কাজটি করে একটি ইতিহাস গড়লেন তিনি। জটিল এক্সিলারী আর্টারী রিপেয়ারিং এ সফলতা অর্জন করল শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সার্জনরা।
গাজীপুরের শহীদ তাজ উদ্দিন আহমেদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক সার্জন ডাঃ কৃষ্ণ কুমার দাশ জানান, মোরসালিনকে নিয়ে হাসপাতালে আসে তার আত্নীয়স্বজনরা। তার ডান হাতের বগলের নীচে মারাত্নক জখম ছিল। এতে হাতের প্রধান রক্ত সাপ্লাই নালী যাকে অক্সিলারী আর্টারী বলা হয়, তা কেটে যায়। ফলে রোগীর প্রচুর রক্তক্ষরন হয়। এতে শিশুটির জীবন সংকটাপন্ন অবস্থায় চলে যায়। এই অক্সিলারী আর্টারী নষ্ট হলে হাত বাতিল হয়ে যায়। এ ধরনের একটা জখম নিয়ে ইমার্জেন্সীতে নিয়ে আসলে তাকে প্রাইমারী মেনেজম্যান্ট দিয়ে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে আসে। কিন্ত এ ধরনের রক্তনালীর ইনজুরি রিপেয়ার করার মত সক্ষমতা সাধারনত বাংলাদেশের জেলা হাসপাতালগুলোতে কোথাও নেই। এ্ই কাজগুলি সাধারনত হয়, ঢাকার জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতালে। এমনকি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ক্যাজুয়ালটি বিভাগের যে সব রুগি আসে. তাদেরকে অন্যান্য মেনেজমেন্ট দিয়ে রক্তনালীকে রক্ত বন্ধ করে সেখানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এ রোগীর ক্ষেত্রে আমরাও আমাদের সিনিয়র অথরিটির সাথে কথা বলে প্রথম সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, ঢাকায় পাঠিয়ে দেব।
তিনি বলেন, পাঠিয়ে দেওয়ার মুহুর্তে আমরা দেখলাম রোগীটা মারা যাওয়ার পথে -গোয়িং টু ডাই- এরকম একটা অবস্থায় রয়েছে। একে তো বাচ্চা মানুষ, তারপর মেজর একটি ধমনী কাটা গেছে, প্রচুর রক্তক্ষরন হয়েছে, অলমোস্ট শরীরের ৫০ ভাগ রক্ত চলে গিয়েছিল। বাচ্চাটি কথা বলার মত অবস্থায় ছিল না, শরীর ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল। জিহবা, ঠোট নীল হয়ে গিয়েছিল ।
এটা দেখে আমারও অনেক খারাপ লেগেছে । এ অবস্থায় আমি ব্যক্তিগতভাবে চিন্তা করলাম যে, চোখের সামনে এইভাবে একজন রোগী মারা যাবে, আমি তো কিছু কাজ জানি, আমিও তো কিছু করতে পারি। কিন্ত কাজটা করার জন্য যে সব ফ্যাসিলেটিজ বা সুযোগ সুবিধা থাকার কথা, তা এ হাসপাতালে নেই বা ওইভাবে এখনো ডেভেলপ হয়নি । আমি ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিয়ে এনেসথেসিয়া ইনচার্জ, আইসিও ইনচার্জ- উনাদেরকে রিকোয়েসট করে, অপারেশন করার জন্য যে সুতাগুলো তা আশেপাশের বিভিন্ন জায়গা থেকে, রক্তনালী ধরার জন্য যে ক্ল্যাম্প লাগে, তা বিকল্প উপায়ে তৈরী করে -আমরা অপারেশন সফল করি। আমার সাথে আরো ছিলেন, সহকারী রেজিষ্ট্রার ডাঃ সজীব, আবেদনবিদ -এনেসথেসিস্ট- ডাঃ মাইনুল ইসলাম- ডাঃ আরিফ- ডাঃ শামীম- ইন্টার্ন চিকিৎসক ডাঃ মল্লিকা হাসান, ডাঃ সাজমুস সাকিব, ডাঃ মাহমুদা খাতুনসহ কয়েকজন সেবিকা ও ওয়ার্ড বয় ।
তিনি জানান- পুরো প্রসিডিওর সম্পন্ন করতে ওটি -অপারেশন থিয়েটার- তে সময় লেগেছে পৌনে এক ঘন্টার মত। আমরা বিকেল ৬ টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত কাজ করেছি। আমরা খুব অনিশ্চয়তায় ছিলাম যে, হাতটা আমরা বাঁচাতে পারব কিনা। রোগীটি বাঁচবে কি না এসব নিয়ে। রোগীর লোকজনও প্রচুর সহযোগিতা করেছেন, রক্ত দিয়েছেন। হাসপাতালের সবার সহযোগিতা ও আনুষঙ্গিক অন্যান্য মেনেজম্যান্ট ঠিকমত হবার কারনে আমরা পেরেছি।
রোগী এখন অনেক ভাল। আমাদের জন্য অনেক খুশির সংবাদ যে- এই বাচ্চাটিকে দেখতে এ হাসপাতালের এমন কেউ নেই -যে আসেনি। অনেক ডাক্তাররাও দেখতে এসেছেন।
এ ধরনের অপারেশন করতে কি কি সমস্যা রয়েছে- জানতে চাইলে তিনি বলেন- এ ধরনের অপারেশন এ হাসপাতালে এটাই প্রথম। একটি মেজর ইমার্জেন্সী রক্তনালী আমরা রিপেয়ার করেছি। অপারেশন করার জন্য যে সব জিনিস লাগে- তা ্এখানে ছিল না- ম্যানেজ করতে হয়েছে। আসলে সব সময় এ ধরনের রোগী যেহেতু আসে না, তাই সব জিনিস লাগে না বলে এখানে এসব এভেইলেবল ছিল না।
তিনি বলেন, আমরা যেটা সবচেয়ে বেশী সমস্যা অনুভব করেছি, তা হল, এনেসথেসিয়া করার জন্য বা রোগীকে অজ্ঞান করার জন্য সকালের পরে ডাক্তারের একটি সংকট রয়েছে। আমাদের এখানে বাচ্চা রোগীকে অজ্ঞান করার জন্য বিকেল বা রাতের শিফটে দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে। সকাল ৯টা থেকে ২ টা পর্যন্ত অজ্ঞান করার ডাক্তার থাকে, কিন্ত এর পর দক্ষ জনবল থাকে না।
এখানে ভবিষ্যতে এ ধরনের রোগীর জন্য ২৪ ঘন্টার দক্ষ অজ্ঞান করার জনবল থাকা জরুরী। পাশাপাশি আলাদা ক্যাজুয়ালটি ডিপার্টমেন্ট থাকা দরকার, যেখানে সার্বক্ষনিক আবাসিক সার্জন- দক্ষ নার্স- স্টাফ থাকবে- সব ধরনের সাপ্ল্ইা থাকবে। তাহলে ভবিষ্যতে এ ধরনের রোগী আসলে অপারেশন করা যাবে। মোরসালিনের গ্রামের বাড়ী গাজীপুরের কালিগঞ্জ উপজেলার জাঙ্গালীয়া গ্রামে।
বৃহস্পতিবার হাসপাতালের বেডে কথা হয় তার চাচা রুবেল ও মা মোরশেদা খাতুনের সাথে। তারা জানান- এখানকার ডাক্তারদের আপ্রাণ চেষ্টার কারনে এ ধরনের একটি জটিল অপারেশনের কারনে সে বেঁচে যায়। প্রথমত সব কৃতিত্ব কৃষ্ণ স্যারের । এছাড়াও অন্যান্য যে সব ডাক্তারগন ছিলেন, তাদের সবার প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। সকলের আন্তরিক প্রচেষ্টায় আল্লাহ আমাদের বাচ্চাটিকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
এ ব্যাপারে হাসপাতালের পরিচালক ডাঃ মোঃ আমিনুল ইসলাম বলেন, আমরা যে জটিল ধরনের কাজ করতে পারি- আমাদের সক্ষমতা আছে, এ অপারেশনের মাধ্যমে সেটাই প্রমান হয়েছে। আমাদের জেনারেল সার্জনরাই কাজটি করতে পেরেছে। তিনি বলেন- যেহেতু গাজীপুর একটি শিল্পঘন এলাকা, তাই এ ধরনের এক্সিডেন্ট বা ঘটনা ঘটতেই পারে। ভবিষ্যতেও এ ধরনের অপারেশন করা সম্ভব হবে।