
তৌহিদ বেলাল, কক্সবাজার।।
পর্যটন নগরী কক্সবাজারের সাথে রাজধানী ঢাকার দূরত্ব প্রায় অর্ধশত কিলোমিটার কমছে। এই রুটে যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসছে। চট্টগ্রামের কর্ণফুলি নদীর তলদেশ দিয়ে নির্মিত ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’ চালু হলে এই দূরত্ব কমে আসবে। সব ঠিকঠাক থাকলে টানেলটি আগামি জানুয়ারিতে চালু হতে যাচ্ছে।
চট্টগ্রাম থেকে রাজধানী ঢাকায় যাওয়ার সময় ও দূরত্ব কমেছে আরও আগেই। চার লেনের সড়ক চালু হওয়ার পর চট্টগ্রাম-ঢাকা মহাসড়কে যোগাযোগ স্বচ্ছন্দ হয়েছে। তাতে উপকৃত হয়েছেন ঢাকা-চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারে আসা যাত্রীরাও। তবে এখনো কক্সবাজারে আসতে হলে চট্টগ্রাম শহরের বুকের ভেতর দিয়ে আসা লাগে। আর তাতে অনেক সময় ব্যয় হয়। এছাড়া যানযটের দুর্ভোগ তো রয়েছে।
জানা যায়, সড়কপথে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম-ঢাকার দূরত্ব প্রায় ৪২২ কিলোমিটার। এর মধ্যে চট্টগ্রাম-ঢাকার দূরত্ব ২৬৪ কিলোমিটার। আর কক্সবাজার-চট্টগ্রামের দূরত্ব প্রায় ১৫৮ কিলোমিটার। তাই কক্সবাজার থেকে রাজধানী ঢাকায় যেতে পাড়ি দিতে হয় দীর্ঘ পথ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু টানেল চালু হলে রাজধানীর যানবাহনগুলো ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাট হয়ে বন্দর টোল রোডের সঙ্গে নির্মিত আউটার রিং রোড-পতেঙ্গা হয়ে কর্ণফুলী টানেল ব্যবহার করবে। এর ফলে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের দিকে পথ কমবে প্রায় ১৫ কিলোমিটার। তাছাড়া কর্ণফুলি টানেল হয়ে আনোয়ারা উপজেলার চট্টগ্রাম ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড (সিইউএফএল) ঘাট-চাতরি চৌমুহনি-বাঁশখালি-পেকুয়ার মগনামা হয়ে সরাসরি কক্সবাজার সদরে যুক্ত হলে কক্সবাজারের দিকে সড়ক কমবে আরও প্রায় ৩৫ কিলোমিটার।
সেতু বিভাগ জানায়, দুই টিউব সংবলিত মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩.৩২ কিলোমিটার। তিনটি সংযোগপথের (ক্রস প্যাসেজ) মাধ্যমে যুক্ত থাকবে এই দুই টিউব। বিপদকালে এক টিউব থেকে অন্য টিউবে যাতায়াতের জন্য এই ক্রস প্যাসেজগুলো ব্যবহৃত হবে। কিছুদূর পরপর টানেলের দেয়ালে এই ক্রস প্যাসেজের দূরত্বের নির্দেশনা লেখা থাকবে। টানেল টিউবের দৈর্ঘ্য ২.৪৫ কিলোমিটার এবং ভেতরের ব্যাস ১০.৮০ মিটার।
সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে জানা যায়, টানেলটি কর্ণফুলী নদীর মোহনার কাছে পশ্চিম প্রান্তে পতেঙ্গা নেভাল একাডেমির কাছ থেকে শুরু হয়ে পূর্ব প্রান্তে চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানা (সিইউএফএল) এবং কর্ণফুলি সার কারখানার (কাফকো) মাঝখান দিয়ে আনোয়ারা প্রান্তে পৌঁছেছে। মূল টানেলের সঙ্গে পতেঙ্গা প্রান্তে ০.৫৫০ কিলোমিটার এবং আনোয়ারা প্রান্তে ৪.৮ কিলোমিটারসহ মোট ৫.৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক রয়েছে। এছাড়াও আনোয়ারা প্রান্তে সংযোগ সড়কের সঙ্গে ৭২৭ মিটার উড়ালসড়ক রয়েছে।
জানা গেছে, ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিন পিং কর্ণফুলি নদীতে টানেল প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম টানেল টিউবের বোরিং কাজ উদ্বোধন করেন। পরে ২০২০ সালের ১২ ডিসেম্বর সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের দ্বিতীয় টিউবের বোরিং কাজ উদ্বোধন করেন।
গেল ২৬ নভেম্বর, শনিবার দক্ষিণ এশিয়ায় নদীর তলদেশে প্রথম টানেল ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’র দক্ষিণ টিউবের নির্মাণকাজের সমাপ্তি উদযাপন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি সমাপ্তি অনুষ্ঠানে যোগ দেন।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের মাধ্যমে বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বাড়বে এবং দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে’।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের উন্নয়নে সার্বিক পদক্ষেপ নেওয়ার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে চট্টগ্রামকে নতুনভাবে গড়ে তোলে। কর্ণফুলি নদী গুরুত্বপূর্ণ জায়গা, এখানে আমরা অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলছি। ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’- এভাবেই গড়ে উঠবে চট্টগ্রাম। বিদেশি বিনিয়োগের জন্য আহবান জানিয়েছি। বিভিন্ন দেশ থেকে বিনিয়োগ আসছে। চট্টগ্রামের যোগাযোগটা আরও জোরদার হবে’।
কর্ণফুলি নদীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের মাধ্যমে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আরও বৃদ্ধি পাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী।
সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে জানা যায়, দেশের প্রথম এই টানেল নির্মিত হচ্ছে চীনের আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতায়। ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন রয়েছে এই মেগা প্রকল্প। এখন চলছে টানেলের ভেতরে ফায়ার ফাইটিং, লাইটিং ও কন্ট্রোল ব্যবস্থাপনার কাজ। পরীক্ষামূলকভাবে চালানো হচ্ছে প্রকল্পের গাড়িও। নদীর তলদেশে হওয়ায় যেকোনও সময় পানি জমতে পারে, এমন আশঙ্কায় টানেলের মধ্যে বসানো হচ্ছে ৫২টি সেচ পাম্প। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
টানেলে নদীর তলদেশে স্থাপন করা দুটি টিউবের একটিতে কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে যাতে বিকল্প পথে গাড়ি চালানো যায়, সেটিরও কাজ চলছে। বাতি ও পাম্প স্থাপন, ড্রেনেজ ব্যবস্থা তৈরির কাজও সমানতালে চলছে। এখন চলছে কর্ণফুলি নদীর দক্ষিণ প্রান্তে আনোয়ারা অংশে টোল প্লাজা নির্মাণের কাজ।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, টানেল চালু হলে চীনের সাংহাই শহরের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন এক ধাপ এগিয়ে যাবে। টানেলকে ঘিরে কক্সবাজার থেকে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম ও রাজধানী ঢাকার সঙ্গে সড়ক যোগাযোগে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে।
প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমেদ কায়কাউস গণমাধ্যমকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল করে দিচ্ছেন। সেখানে যেমন দেশীয় বিনিয়োগ থাকবে, তেমনি থাকবে বিদেশি বিনিয়োগও। আর তার জন্য দরকার রাস্তাঘাট, ব্রিজ আর বন্দর। এর সঙ্গে কক্সবাজারের মাতারবাড়ির একটা সম্পর্ক আছে। এছাড়া ঢাকার সঙ্গে কক্সবাজার যাওয়ার দূরত্ব প্রায় ৫০ কিলোমিটার কমে যাচ্ছে’।
তিনি জানান, টানেলের মোট কাজ হয়েছে ৯৫ শতাংশের বেশি। এই টানেল উদ্বোধন হলে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার বাড়বে ০.১৬৬ ভাগ।
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি আল্লাহর রহমতে প্রধানমন্ত্রী ভালো জায়গায় নিয়ে গেছেন। কোনোভাবে এটি দমানো সম্ভব নয়। অনেকে উদ্বিগ্ন ছিল যে, বাংলাদেশের কী হবে? বাংলাদেশে যখন আইএমএফ এসেছে তখন তারা প্রতিটি সেক্টর পর্যালোচনা করে দেখেছে। যদি মার্কিং করা হয় তাহলে বাংলাদেশ পাবে ‘এ প্লাস’। আর এটি একদিনে হয়নি। বিভিন্ন নীতি ও উন্নয়ন থেকে হয়েছে। আর তারা এতে ইমপ্রেসড হয়েছে’।
টানেলের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) হারুনর রশীদ বলেন, ‘এখন প্রতিটি সিস্টেম কাজ করছে আলাদাভাবে। এরপর এগুলো আমাদের কন্ট্রোল সিস্টেমের সঙ্গে যুক্ত হবে। পাবলিক ব্যবহারের জন্য আমাদের সবকিছু ঠিক করতে হবে। আর সবমিলিয়ে জানুয়ারির শেষ দিকে টানেলের কাজ শেষ হবে বলে আশা করছি’।
তিনি বলেন, ‘আমাদের অনেক চ্যালেঞ্জ ছিলো, আর সেগুলো আমরা অতিক্রম করেছি। প্রথম টিউবে ১৭ মাস লাগলেও পরেরটা ১০ মাসে সম্পন্ন হয়েছে’।